সমীকরণ ডেস্ক: প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা থেকে শুরু করে রিকশা-ভ্যানসহ বিভিন্ন পরিবহনের চালকের ছদ্মবেশে গোটা রাজধানী চষে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর জঙ্গিরা। সম্প্রতি হাজারীবাগ থেকে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আল আনসার (হুজি) নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদিকে সিএনজি অটোরিকশার কয়েকজন মহিলা যাত্রীও একই ধরনের অভিযোগ করেছেন। তারা জানান, এসব চালক তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের নানা বিষয় জানতে চান। ধর্মের পথে না চলার ব্যাপারে তাদের বিভিন্ন কথা বলেন। পরে আকস্মিক মাঝপথে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া না নিয়েই চলে যান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জঙ্গিরা সবসমই নিজেদের পরিচয় গোপন করে চলাফেরা করে। এক্ষেত্রে তারা ভিন্ন ভিন্ন পেশা বেছে নেয়। আবার অনেক সময় নিজ জেলায় মামলা থাকার কারণে ছদ্মবেশে জঙ্গিরা ঢাকা ও চর এলাকায় বসবাস শুরু করে। ঢাকায় জনবসতি বেশি হওয়ার কারণে এখানে সহজেই নিজের পরিচয় লুকানো সম্ভব হয়। সব বিষয় মাথায় রেখেই র্যাব কাজ করছে। সম্প্রতি চালকের ছদ্মবেশে থাকা কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর জঙ্গিদের ছদ্মবেশের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। সিএনজি চালকের বেশে জঙ্গিদের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার এক ঊর্ধ্বতন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে ওই সিএনজি অটোরিকশার নাম্বার জানাতে পারেনি অভিযোগকারী। এ কারণে ওই অটোরিকশা ও চালককে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়টি নিয়েও র্যাব কাজ করছে। তিনি বলেন, অনেক সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এক শ্রেণির লোক এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে থাকে। এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে রাস্তার মধ্যে কোনো ধরনের অঘটন ঘটানোর সুযোগ তাদের নেই। তারপরও র্যাবের গোয়েন্দা সজাগ রয়েছে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী ধারাবাহিক অভিযানের কারণে অনেকটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক। আগে তারা নানাভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা পেলেও সরকারের কঠোর নজরাদারির কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে তারা এখন ভিন্ন ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে। অনেকে আবার নিজের উপার্জিত অর্থেই জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি র্যাব-২ এর একটি দল হাজারীবাগের রায়ের বাজারস্থ শিকদার মেডিকেলের পেছনে ‘আল জামিয়াতুল মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা’ ও এতিমখানার দক্ষিণ পাশের একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় সেখান থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘আল-আনসার’-এর সমম্বয়কারী মো. রাশিদুল আলম ওরফে রাশেদ ওরফে বাবু, মো. আবু বক্কর মনির, মো. আবদুল্লাহ আল মামুন মিয়া, রাইসুল ইসলাম ওরফে রাসেল ও মো. আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করে। এ সময় ওই বাসা থেকে বিভিন্ন ধরনের জিহাদি বই, প্রশিক্ষণ বই, প্রশিক্ষণ প্রেস, প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ইলেকট্রিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় সদস্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে তারা নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘আল-আনসার’ নামে দুবছর আগে কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন মিয়া কম্পিউটারে টাইপিংয়ের কাজ করে, মো. রাইসুল ইসলাম হাওলাদার ওরফে রাসেল প্রাইভেটকার চালক, মো. আবু বকর মনির ও মো. আবদুল মালেক ছদ্মবেশে রিকশাচালক হিসেবে ঢাকায় বসবাস করত। মামলা দায়ের শেষে তাদের হাজারীবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর হাজারীবাগ থানাপুলিশ তাদের রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। মামলার তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে থাকা ওই জঙ্গিরা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) অনেক সদস্য বিভিন্ন পেশার আড়ালে সক্রিয় রয়েছে। আবার অনেকে ছদ্মবেশে চালকের কাজ করছে। সম্প্রতি ডিএমপির এক সংবাদ সম্মেলনে ৫১টি পরিবারকে হুজির পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে বলে জানানো হয়। এরপর থেকে হুজির সদস্যরা বেকায়দায় পড়ে। তারা নিজেরাই আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে নানা পেশা বেছে নিয়েছে। তবে সর্বক্ষেত্রে চাকরি না পাওয়ায় এসব জঙ্গি চালকের পেশা বেছে নেয়। তদন্ত তদারক এক কর্মকর্তা জানান, নতুন রিকশাচালকদের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা লাগে না। জামানত পেলেও রিকশার মালিকরা নতুন চালকের হাতে রিকশা তুলে দেন। আবার গাড়িচালকদের ক্ষেত্রে ভোটার আইডি কার্ড, ছবি ও সদনপত্র লাগে। এসব ম্যানেজ করা যে কোনো চালকের ক্ষেত্রে খুব বেশি কঠিন কাজ না। এ কারণে জঙ্গিরা এখন চালকের ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করছে। রমনা জোনের ডিসি সরদার মারুফ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, হাজারীবাগ থানায় রিমান্ডে থাকা নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৫ সদস্যের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। নতুন তথ্যের সূত্র ধরে আরো জঙ্গি গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জঙ্গিরা যে ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করছে সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। এদিনে নতুন করে কিছু সিএনজি অটোরিকশা চালকদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ তুলেছেন কয়েকজন নারী যাত্রী। তাদের অভিযোগ সিএনজি অটোরিকশায় চড়ার পর চালকরা তাদের কাছে কোনো ধর্মের অনুসারী তা জানতে চান। ইসলাম ধর্মের অনুসারী জানানো হলে তাদের কাছে কলেমা সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। এরপর হিজাব পরার পরামর্শ দিয়ে কোনো এক স্থানে ভাড়া ছাড়াই নামিয়ে দেয়ারও অভিযোগ করেছেন অন্তত তিনজন নারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নারীদের একজন জানান, অটোরিকশা চালকের এমন প্রশ্নে তিনি ভড়কে যান। পরে তাকে নিরিবিলি একটি স্থানে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে ওই চালক চলে যায়। এরপর থেকে তিনি সিএনজি অটোরিকশায় চড়া থেকে বিরত রয়েছেন। বিষয়টি তিনি হ্যালো অ্যাপসের মাধ্যমে পুলিশকে অবহিত করেছেন। পাশাপাশি র্যাবের কাছেও অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার কারণে তিনি ওই সিএনজি অটোরিকশার নাম্বার সংগ্রহ করতে পারেননি বলে জানান।