
সমীকরণ প্রতিবেদন:
ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তেজনার জন্য পশ্চিমারা পুরোপুরি দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আকস্মিক সফরের একদিন পর গতকাল মঙ্গলবার পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে এ মন্তব্য করেন পুতিন। তার এ ভাষণ প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন। খবর এএফপি, আলজাজিরা, সিএনএন ও বিবিসির। পুতিন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের দায়বদ্ধতা, এর উত্তেজনা এবং হতাহতের দায় পুরোপুরি পশ্চিমা অভিজাতদের। দনবাস সঙ্কট শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের সব চেষ্টা রাশিয়া করেছে বলেও জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা প্রতিশ্রুতি স্রেফ প্রতারণা। ‘নিষ্ঠুর মিথ্যা’ ছাড়া তারা আর কিছু বলতে পারে না। পুতিন বলেন, ‘আমরা এই সমস্যাটি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলাম। এই কঠিন সঙ্ঘাত থেকে বের হতে শান্তিপূর্ণ উপায় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু আমাদের পেছন পেছন ভিন্ন দৃশ্যকল্প তৈরি করা হচ্ছে।’ গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় ভাষণ শুরু করেন পুতিন। গোস্টিনি ডভোর হলের এই আয়োজনে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ, অর্থমন্ত্রী আন্দ্রেই সিলুয়ানভ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ, প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল। রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও এতে যোগ দিয়েছেন। বিদেশী সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের ‘বিদেশী এজেন্ট’ হিসেবে বিবেচিত করে চলতি বছর আয়োজনে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ভাষণে পুতিন দাবি করেন, জৈবিক ও পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে কিয়েভ। তিনি বলেন, ‘তারা (পশ্চিম) শুধু সময় নিতে চাচ্ছিল। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তারা চোখ বন্ধ করে থাকে।’ ভাষণে পুতিন তার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেছেন, কিয়েভ সরকারের কাছ থেকে হুমকি এবং ঘৃণার পাশাপাশি নাৎসি আচরণ পেয়ে আসছে রাশিয়া। পুতিন বলেন, ‘ইউক্রেন রাশিয়ার সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছিল। বলা বাহুল্য, এ বিষয়টি কখনোই স্বীকার করবে না ইউক্রেন সরকার।’ ভাষণে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলের বাসিন্দাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন পুতিন। কয়েক মাস আগে বিতর্কিত গণভোটে এ চারটি অঞ্চল রাশিয়ায় যোগ দেয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। পুতিন বলেন, ‘মাতৃভূমির সাথে থাকার সিদ্ধান্তের চেয়ে সাহসী আর কিছুই হতে পারে না। আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের বীরেরা লড়াই করছেন।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কিয়েভ সফরকে রাশিয়া স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখছে বলে জানান ভ্লাদিমির পুতিন।
পুতিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের : তবে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের এক বছর পূর্তির আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাষণ প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন। এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ভাষণে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য পুতিন যেভাবে পশ্চিমা ও কিয়েভকে দায়ী করেছেন তা ‘অযৌক্তিক’। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভান বলেন, কেউ রাশিয়াকে আক্রমণ করছে না। ইউক্রেন বা অন্যদের পক্ষ থেকে এক ধরনের সামরিক হুমকি রয়েছে বলে অযৌক্তিক ধারণা রাশিয়ায় কিছুমাত্রায় বিরাজ করছে। ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এক সিনিয়র উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক বলেছেন, পুতিনের ভাষণ তার ‘অপ্রাসঙ্গিকতা এবং বিভ্রান্তি’ প্রমাণ করছে। তিনি বলেছেন, পুতিন জোর দিয়ে বলছেন রাশিয়া অচলাবস্থায়, কোনো সমাধান নেই এবং থাকবে না। কারণ সব জায়গায় নাৎসি, মঙ্গোললীয়রা এবং ষড়যন্ত্র রয়েছে। যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা ও কিয়েভকে দায়ী করায় অস্ট্রিয়ায় নিযুক্ত ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূত পুতিনকে ‘মিথ্যাবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্থগিত ঘোষণা : তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্বাক্ষরিত কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ (স্ট্র্যাটেজিক আর্মস রিডাকশন ট্রিটি) স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পার্লামেন্টে ভাষণের শেষে আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি আজ এই বিষয়ে ঘোষণা দিতে বাধ্য হচ্ছি যে, কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তিতে রাশিয়া তার অংশগ্রহণ স্থগিত করছে।
২০১০ সালে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে ‘দ্য নিউ স্টার্ট’ নামের দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করে বিশ্বের দুই শীর্ষ পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর গত বছর এই চুক্তির মেয়াদ আরো পাঁচ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেড, স্থল ও সাবমেরিন-ভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক বোমাবাহী বিমান মোতায়েনের লাগাম টানা হয়। বিশ্বে বর্তমানে রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটির কাছে প্রায় ৬ হাজার ওয়ারহেড রয়েছে। নিউ স্টার্ট চুক্তি অনুযায়ী, এই দুই দেশের কেউই এক হাজার ৫৫০টির বেশি কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেড মোতায়েন করতে পারতো না। যৌথভাবে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে; যা এই বিশ্বকে বহুবার ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।
বাইডেনের কিয়েভ সফরে ক্ষিপ্ত মস্কোর পণ্ডিতরা : এ দিকে ইউক্রেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আকস্মিক সফর রাশিয়ার অনেক যুদ্ধবাজ সামরিক পণ্ডিতকেই ক্ষিপ্ত করেছে, ফেলেছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। এই সফর এমনকি ধুঁকতে থাকা সামরিক অভিযানের ন্যায্যতা নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপও বাড়িয়েছে। বাইডেনের সফরটি একইসাথে রাশিয়ার সামরিকপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী মহলকে ক্রুদ্ধ করেছে।
নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে রাশিয়ার সাংবাদিক সের্গেই মারদান তির্যক ভাষায় মন্তব্য করেছেন, ‘কিয়েভে গিয়ে বাইডেন রাশিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন। অলৌকিক হাইপারসনিক অস্ত্রের গল্প সম্ভবত শিশুদের জন্য তুলে রাখা হয়েছে। যেমনটা তোলা আছে পবিত্র যুদ্ধের মন্ত্র, যেই যুদ্ধ আমাদের করতে হচ্ছে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের সাথে। আমার মনে হয়, পবিত্র যুদ্ধে দুপুরের আহারের বিরতি চলছে।’
অভিজ্ঞ রুশ সেনা ও সাবেক কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এফএসবি) কর্মকর্তা ইগর গিরকিন ক্ষোভজড়ানো ভাষায় লিখেছেন, বাইডেন চাইলে ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রেও যেতে পারতেন, এবং সম্ভবত অক্ষতই ফিরতেন। গিরকিন বলেন, ‘দাদুকে (বাইডেনকে ইঙ্গিত করে এমনটাই লিখেছেন তিনি) যদি বাখমুতেও নিয়ে আসা হতো, তাও তাজ্জব হতাম না, তারপরও তার কিছুই হতো না।’
রাশিয়ার যে কট্টরপন্থী সামরিক ব্লগারদের লাখ লাখ অনুসারী আছে এবং যাদের পর্যালোচনা রুশ জনগণের বড় অংশকে প্রভাবিত করে গিরকিন তাদের অন্যতম। এই সামরিক ব্লগাররা অবশ্য আগে থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে পুতিনের জেনারেলদের ‘নরম’ অবস্থানের ধারাবাহিক সমালোচনা করে আসছিলেন। রুশ সেনা ও নৌ বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট জাপিস্কি মিচমানা পিচকিনা ব্যঙ্গভরে লিখেছে, কিয়েভে বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের আগে পৌঁছে গেলেন। তারা বলেছে, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর প্রায় এক বছর হতে চলল, আমরা রুশ শহর কিয়েভে রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টের অপেক্ষায় ছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অপেক্ষায় নয়।’