যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলন; আমন্ত্রণ না পাওয়ার কারণ কী

সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি বাংলাদেশ। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বাদ পড়ল বাংলাদেশ। গত বছরও জানুয়ারিতে এ সম্মেলন হয়। সে সময় উপমহাদেশের আরেক দেশ পাকিস্তানও বাদ পড়েছিল। এবার ২৯-৩০ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে পাকিস্তান আমন্ত্রণ পেয়েছে। এ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছে ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল। বাদ পড়েছে শ্রীলঙ্কা। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর দ্বিতীয় গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রিত ১১০টি দেশের নাম প্রকাশ করে। তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র সম্মেলনে ডাক পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। গত বছরও তিনি একই কথা বলেছিলেন। তখন প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বাংলাদেশে তো স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিদ্যমান। এটি অত্যন্ত স্বচ্ছ গণতন্ত্র। জনগণ সুষ্ঠু ও মুক্তভাবে ভোট দিতে পারছে। এ দেশে সব মানুষ ভোট দিতে পারে। পরে মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, বাইডেন প্রশাসন পরের বছর বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাবে। মন্ত্রীর সেই আশায় গুড়েবালি ঢালল যুক্তরাষ্ট্র। ঘটনাগুলো বাংলাদেশের সরকারের জন্য কতটা বিব্রতকর তা অনুমান করা কঠিন। কারণ এর কোনো দৃশ্যমান বহিঃপ্রকাশ নেই। তবে জনগণ লজ্জা বোধ করে। বিশে^র প্রচারমাধ্যমে যখন খবরটি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যায় তখন দেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি সে কথাই বলেছে। দলের এক নেতা বলেছেন, অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। গণতন্ত্র, নির্বাচন ও রাজনীতিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বেড়াজালে দেশবাসীকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। দেশের গৌরবোজ্জ্বল গণতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপির বক্তব্যে রাজনীতি থাকতে পারে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত মার্জিত ও শিষ্টাচারসম্মত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বা সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের সামান্য আভাসও নেই তাতে। এটি লক্ষ্য করার মতো বিষয়। তবে এ নিয়ে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রতিবেশী দেশের গণমাধ্যম কিছুটা হা-হুতাশ করে। গত বছর বাংলাদেশের বাদ পড়া নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ছিল- চীনের মদদ পাওয়া কিছু দেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনের বাইরে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তার পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনছে। যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যম ব্লুমবার্গে জনৈক মিহির শর্মা লিখেছিলেন, বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির কূটনীতির লেজেগোবরে অবস্থার প্রতিফলন। এসব মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না; বরং দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কতটা মরিয়া বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে বাদ দেয়া ও তাইওয়ানকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যে সেটি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কখনোই অস্পষ্ট নয়। ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য বিবৃতিতে সেটি সবসময়ই বলিষ্ঠভাবে সামনে এসেছে। খুব সম্প্রতি মার্কিন কর্মকর্তাদের একের পর এক ঢাকা সফরেও একই অবস্থান তুলে ধরা হয়। দেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিরাজমান, সবাই অবাধে ভোট দিতে পারে, মানবাধিকার পরিস্থিতি আমেরিকার চেয়ে ভালো, সরকারের এসব বাগাড়ম্বর দেশের মানুষের জন্য হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু বিশ্বের সবাই তা গিলবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। সমস্যা হলো, এ সত্য সরকার কতটা অনুধাবন করে তা জানার উপায় নেই। সম্ভবত ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় সহযোগিতায় বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভূমিকা এ ক্ষেত্রে প্রধান অনুঘটক। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য শেষ পর্যন্ত কোন দাগে গিয়ে স্থির হয় তার ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু। গণতন্ত্র সম্মেলন থেকে বাদ পড়াটা শরীরের বাইরের ফুসকুড়ি মাত্র। ভেতরের জ্বর নিরাময়ে কার্যকর দাওয়াই লাগবে।