
সমীকরণ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এখন মন্তব্য করা কঠিন। সবকিছুই নিশ্চিত। আবার কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। এমনিতে মানুষের প্রধান ইস্যু রাজনীতি নয়। বরং তারা উদ্বিগ্ন দৈনন্দিন খরচ নিয়ে। কতো বিষণ্ন মানুষের মুখ যে দেখা যায় বাজারে। লিস্ট ছোট করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন তারা! দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে আর কতো লড়াই করা যায়। গরুর মাংস মধ্য ও নিম্নবিত্তের প্লেটে ঠাঁই পায় না অনেকদিন হলো। সবশেষ রেকর্ড করেছে ব্রয়লার মুরগি। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আরও কতবার যে বাড়বে বলা মুশকিল। সত্যিই মানুষ আর পারছে না।
এই যখন অবস্থা- তখন দরজায় কড়া নাড়ছে নির্বাচন। আগামী ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে ভোট। অথচ এ নিয়ে কোথাও তেমন কোনো আলোচনা নেই। যেন সবাই জানেন কী হবে! পাবলিক বাস কিংবা চায়ের দোকানে ভোটের আলাপ নেই বললেই চলে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনও ভোটার টানতে পারেনি। অনেকে বলেছেন, এটাই আগামী নির্বাচনের মডেল। সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত কোনো কোনো ব্যক্তিতো বলছেন, এটাই পারফেক্ট। তবে সেগুনবাগিচা, গুলশান, বারিধারায় ভোটের আলাপ আছে। বিদেশিরা তৎপর। একের পর এক সফর, মিটিং। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান প্রায় পরিষ্কার করেছে। সবশেষ সফর করে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন কর্মকর্তা ডেরেক শোলেতো প্রকাশ্যই কঠোর বার্তা দিয়েছেন। গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ কেন আমন্ত্রণ পায়নি বলে গেছেন তাও। মার্কিন পলিসি ডকুমেন্টেও বাংলাদেশের ব্যাপারে স্পষ্ট নীতি প্রকাশ পেয়েছে। মার্কিন মিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বর্ণনায় বলা হয়েছে- গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও স্বচ্ছতার প্রতি বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। অবাধ, স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথাও বলা হয়েছে সেখানে। ভোট প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থানও যক্তরাষ্ট্রের মতোই। তারাও অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান। তবে কীভাবে তা পরিষ্কার নয়। বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের অবস্থান কী? গত দু’টি নির্বাচনের সময়কার চেয়ে বড় কোনো পরিবর্তনের চিত্র দেখা যাচ্ছে না। এরইমধ্যে মস্কোয় অনেকটা নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রুশ জাহাজকে বাংলাদেশে ভিড়তে না দেয়াতেই এই তলব। আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একধরনের টানাপড়েন চলছে।
আগামী নির্বাচন প্রশ্নে দৃশ্যত যখন আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে তখন আলোচনায় এসেছে দু’টি বিষয়। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা নিয়ে একাধিক মন্ত্রী কথা বলেছেন। যদিও শেষদিকে এসে তাদের মতামতে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, সংকট সমাধানে সংলাপের বিষয়টিও নতুন করে সামনে এসেছে। কেউ কেউ বলছেন, পর্দার আড়ালে এক ধরনের আলোচনা চলছে। যদিও ওয়াকিবহাল কোনো সূত্রেই তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তির পর থেকেই গুলশানের বাসায় আছেন বেগম খালেদা জিয়া। গুরুতর অসুস্থ হলে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এরবাইরে কোথাও যাচ্ছেন না। তার মুক্তির শর্তেই বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। নেতারা ঈদ-পার্বণে দেখা করেন। কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেই তিনি। সম্প্রতি অনেকটা আচমকাই সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানান, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই। তবে বৃহস্পতিবার এসে মন্ত্রিসভার দুইজন সদস্য এ নিয়ে কিছুটা ভিন্নমত জানান। খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে মন্ত্রীদের এমন মন্তব্যে একধরনের শীতল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিএনপি। বিএনপি’র নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, এ ইস্যুতে সরকারের ভিন্ন কোনো মতলব থাকতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে, অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক বক্তব্যই সরকার অতীতে উপেক্ষা করেছে। এবার এই জোটে জাপানও যুক্ত রয়েছে। তবে তার চেয়ে বেশি বিবেচনায় রয়েছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। বর্তমানে দেশে দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক। সরকারগুলোকে এ নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন বেশ জোরদার, বিস্তৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আগামী নির্বাচন ঘিরে একধরনের সমঝোতার আলোচনা রয়েছে। এক্ষেত্রে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হতে পারে এমনটাও বলছেন কেউ কেউ। আগামী এপ্রিলে এই সংলাপ হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিককে বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সংলাপ অপরিহার্য। সংলাপ কখন ও কীভাবে হবে তা সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।’ সংলাপ হলে তা কীভাবে এগোয় তা নিয়ে রাজনীতিতে বড় ধরনের কৌতূহল থাকবে। এরইমধ্যে পর্দার আড়ালে সংলাপের গুঞ্জনও রয়েছে। তবে বিএনপি’র তৃণমূল থেকে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে এ ব্যাপারে কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে যে, আসন ভাগাভাগির কোনো সমঝোতা মানা হবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের তৎকালীন রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েছিলেন যা সফল হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও সংলাপ হয় গণভবনে।
বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে সেক্ষেত্রে কী হবে? সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেলের কথা এক্ষেত্রে আলোচনায় রয়েছে। বিএনপি ছাড়া অন্য যত বেশি সম্ভব দলকে নির্বাচনে আনা যায় তার প্রচেষ্টা নেয়া হবে। বিএনপি’র যেসব নেতা নির্বাচনে আগ্রহী তাদের জন্যও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা হবে। রাজপথ নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকায় থাকবে সরকারি দল। এমনিতে বিরোধীদের আন্দোলনের প্রায় সব কর্মসূচির দিনেই আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের বার্তা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ।
ওদিকে, বিএনপি’র সরকার বিরোধী আন্দোলনের গতি এখন কিছুটা শ্লথ। বিশেষ করে ১০ই ডিসেম্বরের আগের এবং পরের গতির মধ্যে বেশ তারতম্য রয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে শরিক অন্য দলগুলোও যে খুব বেশি লোকসমাগম করতে পারছে এমনটা নয়। বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, মার্চ মাসে বড় ধরনের কর্মসূচি দেয়া হবে। আন্দোলনকে নতুন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থনৈতিক সংকট এবং বিদেশি চাপ, নেতাকর্মীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সবমিলিয়ে আন্দোলনে সফলতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী দলটির নীতি-নির্ধারকরা। তবে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে তা নিয়ে তাদের খুব বেশি স্পষ্ট ধারণা নেই। দল যদি নির্বাচনে জয়ী হয় তাহলে সরকারে নেতৃত্ব দেবেন কে- বিএনপি’র ভেতরে-বাইরেও এ প্রশ্ন রয়েছে। এ নিয়ে দলের ভেতরে কখনও খোলামেলা আলোচনাও হয়নি। এছাড়া, বিএনপি’র আন্দোলনের কৌশল যেন ফাঁস না হয় সেদিকে জোর দিচ্ছেন নীতি-নির্ধারকরা। কারণ অতীতে এ অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। যুগপৎ আন্দোলনের শুরুতে থাকলেও এখন দূরে রয়েছে জামায়াত। দলটি আলাদা কর্মসূচি পালন করছে।
জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই যুগপৎ আন্দোলনে না থাকার কথা জানানো হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। তবে জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি’র পক্ষ থেকে অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হচ্ছে না। যুগপৎ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জামায়াত কর্মীরা পুলিশের অ্যাকশনে পড়লেও এ নিয়ে বিএনপি’র পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করা হয়নি। এরপর থেকেই জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরে যায় বলে দলটির দাবি। এখন তাহলে জামায়াত কি করবে? তারা কি সরকারের সঙ্গেই থাকবে? এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব এখনও কাটেনি। দৃশ্যত সরকারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন রওশন এরশাদ। স্বতন্ত্র অবস্থানের পক্ষে জিএম কাদের। তাকে ঘিরে বিরোধী রাজনীতিতে এক ধরনের বড় মেরূকরণের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এরপরই নানামুখী চাপে পড়েন তিনি।
আগামী নির্বাচন নিয়ে শুরুতে আত্মবিশ্বাসী দেখা গিয়েছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে। তিনি পর্দার আড়ালেও তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। সর্বশেষ তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ওপরই জোর দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সিইসি বলেন, নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে, নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে সে প্রশ্নের নিরসন এখনও হয়নি। দু’টি দল এখনও অনড় অবস্থানে রয়েছে। আমরা আশা করি আগামী কয়েকমাসেই একটা রাজনৈতিক সমঝোতা হয়ে যাবে।
শেষ কথা: এই নগরীতে আশার কথা খুব বেশি শোনা যায় না। তবুও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সিইসি আউয়াল। বাস্তবতার জমিনে পা রাখা জনগণও নিশ্চয় আশাবাদী। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটে জেরবার জীবন রাজনীতির কারণে আরও জটিল হোক- তা নিশ্চয় তারা চান না। টেবিলে অতীতে সংকটের সুরাহা হয়নি বলে ভবিষ্যতেও যে হবে না- এমন কোনো কথা নেই। জীবন ও রাজনীতি বিচিত্র। এখানে ধারণার বাইরেও বহু কিছু ঘটে।