চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকাতেই হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলার চর্চা
মেহেরাব্বিন সানভী:
বাংলাদেশে ইতিহাস-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বাঙালির রক্তে মিশে ছিল ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, যা কালের বিবর্তনে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে চুয়াডাঙ্গা শহরেই এই লাঠি খেলার চর্চা এখনো হয়। প্রায় ৪০ জনের একটি দল প্রতিরাতেই নিয়মিত চর্চা করে লাঠিখেলার ১৬ থেকে ২০টি কৌশল চর্চা করে। খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছে ১২ বছরে কিশোর থেকে শুরু করে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত।
জীবনের প্রয়োজনে সভ্যতার শুরু থেকেই বাঁশের লাঠি হাতে তুলে নিয়েছিল মানুষ। কখনো প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে, কখনো বা হিং¯্র জীবজন্তুকে প্রতিরোধ করতে লাঠি চালানোর নানা কৌশল আবিষ্কার করেছিল মানুষ। কালক্রমে সেই বাঁশের লাঠি থেকেই ‘লাঠিয়াল’ নামে নতুন পেশার সৃষ্টি হয়েছিল। কালের বিবর্তনে সমাজজীবন থেকে সেই লাঠিয়াল বাহিনীর বিলোপ ঘটলেও রূপান্তর ঘটিয়ে লোকজ ঐতিহ্যে স্থান করে নেয় লাঠিখেলা।
চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের সুমিরদিয়া ডাঙা-পাড়ায় দীর্ঘদির ধরে কালের সাক্ষী হয়ে প্রচলিত নিয়মেই সুমিরদিয়া ডাঙা-পাড়া লাঠিয়াল বাহিনী নামে একটি দল এই লাঠিখেলা চর্চা করে আসছে। তাঁদের মধ্যে সবথেকে বায়োজেষ্ঠ্যের ভাষ্যমতে তাঁর বুদ্ধিকাল থেকে সে এই খেলা দেখে আসছে এবং চর্চাও করছে। মাঝখানে কয়েক বছর বন্ধ ছিলো খেলাটি। চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুন্সি রেজাউল করিম খোকনের পৃষ্ঠপোষকতায় এখন আবার আগের মতো নিয়মিত চর্চা করা হয় লাঠিখেলা।
প্রায় প্রতিদিন রাতে নানা বয়সী মানুষ আগ্রহ নিয়ে ভিড় করে লাঠিয়াল বাহিনীর লাঠি খেলার চর্চা দেখার জন্য। বেশ কিছু দিন পরে, গত শুক্রবারে আড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই লাঠি খেলার একটি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ঢোল, টাশা, কাশা ও ঝুমঝুমির বর্জ্র তালে এদিন প্রায় ১৬ ধরণের খেলা প্রদর্শিত হয়। বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে লাঠি খেলে অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে লাঠিয়াল খেলোয়াড়রা। খেলোয়াড়রা একে অপরের সঙ্গে লাঠি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। লাঠি দিয়ে অন্যের আক্রমণ ঠেকাতে থাকে আবার অন্যকে আক্রমণ করতেও থাকে। আর এরই মধ্যে নিজের চেয়ে বড় লাঠি নিয়ে অদ্ভুত সব কসরত দেখিয়ে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগাতে থাকে লাঠিয়ালরা। খেলার শুরুতেই বন্দনার মাধ্যমে দল বেঁধে আগত দর্শকদের সালাম বিনিময় করেন তাঁরা। এসব দৃশ্য দেখে আগত দর্শকরাও করতালির মাধ্যমে খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেন।
লাঠিয়াল লাল চাঁদ ও আওয়াল জুটির তরবারির খেলা দেখে আনন্দিত হন দর্শকরা। তাঁদের তরবারী চালানোর সময় দুই তরবারীর ঘর্ষণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়। ১২ বছর বয়সি আশিক ও জুবায়ের জুটির খনজর দিয়ে দেখানো খেলাটিও ছিলো অসাধারণ। বয়োজেষ্ঠ্য সোলেমান ও ১২ বছর বয়সী মুন্নার মারি খেলায় অভিভূত অনেকেই। মতিয়ারের এক আঙ্গুলে ঘোরানো লাঠি আর মজিবারের এক আঙ্গুলের ওপরে ঘোরানো বাঁশ তাক লাগিয়েছে সবাইকে। সবমিলিয়ে প্রতিটি খেলায় ছিলো অসাধারণ।
এ খেলায় অংশগ্রহণ করে সুরিদিয়া ডাঙাপাড়া লাঠিয়াল বাহিনীর সভাপতি মজিবার, সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার, সহসধারণ সম্পাদক লাল চাঁদ, সাংগঠনিক সম্পাদক জান আলী, সদস্য লালু, কেরামত আলী, রিপন, বাবু, সোলেমান, আনারুল, সাইদুল, মাজিদুলসহ ছোট বড় মিলে প্রায় ৪০জন।
এ খেলার পৃষ্ঠপোষক চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুন্সি রেজাউল করিম খোকন বলেন, লাঠিখেলার আয়োজনের প্রধান কারণ হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখা। তবে আয়োজন আর চর্চার মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধেও বড় ধরনের এক প্রতিবাদ সম্ভব হচ্ছে। কিশোররা খেলার মাঝে থাকলে যেমন তাঁদের শারিরীক কসরত হচ্ছে, তেমনি মাদকের দিকেও ধাবিত হচ্ছে না। সুমিরদিয়া ডাঙা পাড়ায় মাদকের প্রবণতা নেই বললেই চলে।
সুরিদিয়া ডাঙাপাড়া লাঠিয়াল বাহিনীর সভাপতি মজিবার বলেন, খেলার মধ্যে এক প্রকার আনন্দ পাই আমরা। গ্রামের ১২-১৩ বছর বয়সি বাচ্চা ছেলেরাও ছোট ছোট কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করে। সময় পেলেই তারা খেলতে আসে। আমরাও শেখায়। তা ছাড়া আমরা বাইরেও খেলা দেখাতে যায়। তিনি খেলা দেখার জন্য ০১৯৩৫৫২০০৯৫ নাম্বারে যোগাযোগ করারও অনুরোধ জানান।
