ভোটযুদ্ধের আগে জোটযুদ্ধ
- আপলোড টাইম : ১০:২৮:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮
- / ৩৬১ বার পড়া হয়েছে
ছোট দলগুলোকে কাছে টানতে আ.লীগ-বিএনপির দৌড়ঝাঁপ
ডেস্ক রিপোর্ট: ভোটের হাওয়ায় সরগরম রাজনীতি। বছরের শেষেই অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য আগামী ২৭ ডিসেম্বর সম্ভাব্য ভোটের দিন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। চলতি মাসের ২৫ তারিখের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার হতে যাচ্ছে এমনটাও জানিয়েছেন তিনি। এর আগে অবশ্য নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তফসিল ঘোষণা হবে, এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশনও (ইসি)। সেই হিসাবে ভোটের বাকি আর মাত্র তিন মাসের কিছু বেশি। আর তফসিলের মাত্র দুমাস। স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনীতি এখন আবর্তিত হচ্ছে নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, আরপিও সংশোধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ, ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশসহ সামগ্রিক নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সার্বিকভাবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণ উপযোগী ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছে ইসি। এমন পরিস্থিতিতে বসে নেই রাজনীতিকরাও। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতে চলছে জোট-মহাজোট গঠনের দৌড়ঝাঁপ। বড় দু’দলের এই টানাহেঁচড়ায় রাজনীতির মাঠে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ছোট দলগুলোও।
নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠের মৌসুমি খেলোয়াড়রাও তৎপর। আওয়ামী লীগ-বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে নিজেদের কদর বাড়াতে এবং ভোটের বাজারে দুয়েকটি আসন বাগাতে দিনরাত একাকার করে ফেলছেন তারা। বৈঠকের পর বৈঠক চলছে নিজেদের মধ্যে। কী করে নিজেদের আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা যায় তা নিয়ে চলছে নানা কসরত। পিছিয়ে নেই বাম-ডানের রাজনীতিকরাও। তারাও কেউ আন্দোলনের ডুগডুগি বাজাচ্ছেন, কেউবা ঐক্যের ফানুশ উড়াচ্ছেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছে। ২০ দলীয় জোটের মধ্যেই তাদের সমমনা দলগুলোকে একত্রিত করছে। জোটের বাইরে থাকা তাদের মিত্রদেরও কাছে টানছে। রাজনীতির মাঠে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপিও। সরকারি দলের বাইরে থাকা সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করে বৃহত্তর একটি প্লাটফরম করতে দীর্ঘদিন ধরে নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় আগ্রহ থাকলেও এত দিন অনেক দল বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যে সাড়া দেয়নি। ফলে অনেকটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। জামায়াতকে ২০ দলে রেখে বৃহত্তর ঐক্যে আগ্রহী দলগুলোকে নিয়ে আলাদা প্লাটফরম দাঁড় করাতে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বিএনপির। তাদের এ অবস্থানে ইতোমধ্যেই সাড়া মিলেছে বেশ কয়েকটি দলের। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যের প্লাটফরম ততই দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইতোমধ্যেই বিএনপির সঙ্গে ঐক্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, আ স ম রবের জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য। তারা যুক্তফ্রন্ট নামে একটি জোটও গঠন করেছে। গত ২৮ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় দীর্ঘ বৈঠকে এ জোট চূড়ান্ত হয়। তবে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টের পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা আসতে পারে। কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও ঐক্যে আগ্রহী। কিন্তু সেখানে বড় বাধা জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত বিএনপির সঙ্গে থাকায় কাদের সিদ্দিকীকে আপাতত এতে দেখা যাচ্ছে না। তবে তিনি যুক্তফ্রন্টে যোগ দিতে পারেন। যুক্তফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে তার ওঠাবসা রয়েছে। জামায়াত ইস্যুতে ঐক্য না হলেও আগামীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা নির্বাচন যাই হোক না কেন তাতে আলাদা অবস্থান থেকে যোগ দেবে যুক্তফ্রন্ট। তেমনি জামায়াতও তার অবস্থান থেকে এতে অংশ নেবে। নির্বাচনে আসন ভাগাভাগিও হবে পৃথক জোটভিত্তিক। যেমনটা ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন ও নির্বাচনে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী।
বিএনপির সমর্থনে গঠিত বৃহত্তর এ ঐক্যে যোগ দিতে পারে ববি হাজ্জাজের ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) ও জোনায়েদ সাকির গণসংহতি। দল দুটির সাম্প্রতিক তৎপরতায় তেমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আগামীকাল শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এনডিএম নির্বাচনসংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে যাতে বিএনপি মহাসচিবসহ ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। সেখানে দেখা যেতে পারে জোনায়েদ সাকিকেও। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানেও তাদের বিএনপি মহাসচিবের পাশে দেখা গেছে। একই অবস্থা সরকারি দল আওয়ামী লীগের। তারা তাদের ১৪ দলীয় জোটকে আরো সম্প্রসারণ করতে চায়। এতে যোগ দিতে ইতোমধ্যেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে এককালীন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় জোট। জাতীয় জোটের সদস্য দলগুলো হলো- তৃণমূল বিএনপি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, সম্মিলিত ইসলামিক জোট, কৃষক শ্রমিক পার্টি, একামত আন্দোলন, জাগো দল, ইসলামিক ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক জোট। এর বাইরে বাংলাদেশ লেবার পার্টির একটি অংশও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে।
এছাড়া এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও সরকারি দলের সঙ্গে একই প্লাটফরমে আসতে প্রস্তুত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে হবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তবে কৌশল পাল্টাবেন এরশাদ। সে ক্ষেত্রে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে এককভাবে নির্বাচন করবে জাপা। এরশাদের নেতৃত্বেও একটি জোট রয়েছে। এই জোটের শরিক অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল। সর্বশেষ ৫ দফা অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিশ। তবে এরশাদের বর্তমান অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে। যদি কোনো কারণে পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের প্রতিকূলে যাওয়ার সম্ভাবনা এরশাদ টের পান সে ক্ষেত্রে তিনি খেলার মাঠ বদলে ফেলতে পারেন। তাকে দেখা যেতে পারে ২০ দলীয় জোটে কিংবা ঐক্য প্রক্রিয়ায় অথবা তার নেতৃত্বাধীন দল ও জোট আলাদা অবস্থান নিয়ে বিএনপির পক্ষে আওয়ামী লীগ বিরোধী শিবিরে খেলতে দেখা যেতে পারে। অবশ্য এমনটা হলে আগামী নির্বাচনের পরে সরকার গঠন প্রশ্নে বিএনপির কাছে রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে দর কষাকষি করবেন তিনি। রাষ্ট্রপতি পদ নিশ্চিত হলেই তাকে জোট পাল্টাতে দেখা যাবে- এমন কানাঘুষা রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
অবশ্য বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন এরশাদ। তিনি বলেছেন, যেখানে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে সেখানেই থাকবে জাতীয় পার্টি। তার মতে, কারো ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবেন না তিনি ও তার দল। প্রয়োজনে একক দল হিসেবে নিজেই ক্ষমতার যাওয়ার চেষ্টা করবে জাপা। তার এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রপতি পদই তার এখনকার লক্ষ্য। যদিও আওয়ামী লীগের কাছেও রাষ্ট্রপতি পদ চেয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ অবশ্য তার জোটকে আরো বাড়াতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলোচনা করেছেন কাদের সিদ্দিকী, এলডিপির কর্নেল অলি আহমেদের সঙ্গে। কথা বলেছেন বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের সঙ্গেও। নির্বাচনের আগে নানান নাটকীয়তায় এদেরও সরকারি জোটে দেখা যেতে পারে। এর বাইরে ছোট-খাটো অনেক দলকে দেখা যেতে পারে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে, যা অনেকটা ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ের মহাজোটের আদল পেতে পারে। ইতোমধ্যে গঠিত বামদের ঐক্য প্রক্রিয়ায় ৮টি বামদল যুক্ত হয়েছে। আগামী নির্বাচনে তাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করতে দেখা যেতে পারে।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী নির্বাচনে ১৪ দলের কলেবর বাড়ছে। সংসদের ৬৫-৭০টি আসন শরিকদের জন্য ছেড়ে দিতে রাজি আছে আওয়ামী লীগ। চলতি মাস থেকেই আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক আসনগুলোতে তাদের প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সব দলকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে আমি সর্বোচ্চ আশাবাদী। তিনি বলেন, সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, আমাদের ঐক্য হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বাঙালি জাতির একটা বৈশিষ্ট্য হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এই অন্যায় থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। যারা অসাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্র বিশ্বাস করেন- আসুন মানুষের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হই। এটা বহুবার প্রমাণিত, ঐক্যবদ্ধ হলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ না হলে গণতন্ত্র হবে না। গণতন্ত্রের মূল শর্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচনের সময়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বাস্তবায়নেই আমাদের ঐক্য।