২৫ কোটি টাকার মিথ্যা কাবিনে বিয়ে, চাকরি দেয়ার কথা বলে ১৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ
সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভুয়া নবাব সেজে কথিত আলী হাসান পুরো দেশে প্রতারণার জাল তৈরি করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন ভয়ঙ্কর একটি চক্র। প্রতারণার জন্য প্রতিটি জেলায় তার আলাদা আলাদা এজেন্ট ছিল। এসব এজেন্টরাই ওইসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। আলী হাসান বিভিন্ন প্রলোভনে এখন পর্যন্ত ছয় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমন তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে ধারণা করা হচ্ছে হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ আরো বেশি। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা আলী হাসান ও তার স্ত্রী মেরিনা আক্তারের বিয়ের একটি কাবিননামা পেয়েছেন। যেখানে আলী হাসান ২০০৪ সালের ২১শে জুন চুয়াডাঙ্গার মেয়ে মেরিনা আক্তারকে ২৫ কোটি টাকা ভুয়া কাবিনে বিয়ে করেন। এদিকে চাকরি দেয়ার কথা বলে ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে নবাবের নাতি পরিচয়দানকারী আলী হাসান আসকারী, তার স্ত্রী ও শ্যালকের নামে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা করেছে দামুড়হুদা উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সহিদুল ইসলামের ছেলে রফিকুল ইসলাম। গত সোমবার রাতে রফিকুল ইসলাম সদর থানায় হাজির হয়ে এ মামলাটি করেন। রাতেই থানা অভিযান চালিয়ে মামলায় দ্বিতীয় আসামি আসকারীর শ্যালক রায়হান উদ্দীন জনিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এদিকে, ২০০৪ সালে ২৫ কোটি টাকা কাবিনে বিয়ের বিষয়টিকে মিথ্যা কাবিননামা বলে ধারণা করছেন সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মেরিনা আক্তার আবার ২০১৬ সালের ৯ই নভেম্বর মো. আল মামুন হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে ডিভোর্স দিয়েছেন। ২০০৪ সালে তিনি আলী হাসানকে বিয়ে করে এখন পর্যন্ত তার স্ত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন। তাহলে ২০১৬ সালে যাকে ডিভোর্স দিয়েছেন তিনি তার স্বামী কীভাবে হন। এমন নানা প্রশ্নের সমাধান এখনো মিলাতে পারছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা।
সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, তারা মূলত আলী হাসান আসকারীর প্রকৃত নাম জানার চেষ্টা করছেন। কারণ এই নাম তার প্রকৃত নাম না। মূলত নবাব পরিবারের উত্তরসূরি সেজে নবাব পরিবারের সম্পত্তি দখলের জন্য সে এই মিথ্যা নাম দিয়ে নবাব সেজেছে। সারা দেশে নবাব পরিবারের ১৬ হাজার একর জমি রয়েছে। এ জন্য সে শুধু নিজের নামই পরিবর্তন করেনি। তার স্ত্রী, সন্তানের নামও পরিবর্তন করেছে। শুধু নাম নয়, আলী হাসান ও তার স্ত্রী মেরিনা আক্তার জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে পাসপোর্ট ও শিক্ষাগত যোগ্যতার সব সনদপত্রের তথ্যও জালিয়াতির মাধ্যমে পরিবর্তন করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে আলী হাসান বলেছেন, তার প্রকৃত নাম ছিল আলী হাসান। নবাব সাজার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘আলী হাসান’ নামের আগে ‘নবাব’ ও শেষে ‘আসকারী’ যোগ করেন। একইভাবে তার স্ত্রীর আসল নাম ছিল মেরিনা আক্তার। নবাবের স্ত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে তিনিও তার প্রকৃত নাম-পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মেরিনার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সনদপত্রের নাম পাল্টে ফেলা হয়। নতুন সনদপত্র অনুযায়ী তার নাম পুরোপুরি বদলে হেনা আসকারী বানানো হয়েছে। আর নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টও বদলে ফেলেন মেরিনা দম্পতি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কামরাঙ্গীরচরের আশরাফাবাদ এলাকায় আলহাজ আব্দুস সালাম নামের এক ব্যক্তি থাকেন। তিনি আগে লালবাগের চাঁদনীঘাটের গৌরসুন্দর লেনের ২১ নম্বর লেনে থাকতেন। সালাম দুই বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর নাম মৃত নাঈমা খাতুন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম জানা যায়নি। আব্দুস সালামের সাত ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা হলেন- সাইফুল ইসলাম, কামরুল হাসান হৃদয়, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী, আহমেদ আলী, রাজা রাশেদ ও রানা। এ ছাড়া রাজিয়া ও রুমি নামে তার দুই মেয়ে রয়েছে। সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত আসকারীর সহযোগী হিসেবে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে আহমেদ আলী, রাজা রাশেদ ও রানা আপন তিন ভাই। তারা তাদের বাবার নাম বলেছেন কামরাঙ্গীরচরের ওই আব্দুস সালাম। তারা দাবি করছেন, তাদের এক ভাই কামরুল হাসান হৃদয় ২০০৫ সালে সৌদি আরব থাকাকালীন মারা গেছেন। তার মরদেহ কোথায় আছে সেটা তারা জানেন। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন কামরুল হাসান হৃদয়ই কথিত সেই নবাব পরিচয় দেয়া আলী হাসান আসকারী। যদিও আলী হাসান দাবি করছে ওই তিন সহোদর তার বেতনভুক্ত কর্মচারী। একদিকে কথিত আসকারী তার প্রকৃত নাম স্বীকার করছে না। অন্যদিকে তার ভাইদেরকেও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যেটুকু তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সেটি থেকে ধারণা করা হচ্ছে তারা চারজনই এক বাবার সন্তান। তবে ডিএনএ টেস্ট করে তাদের প্রকৃত পরিচয় বের করা হবে বলে জানিয়েছেন সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের ছয় কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। এরমধ্যে সালমান নামের যে ব্যক্তি মামলা করেছেন সেখানে প্রায় চার শতাধিক মানুষের ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা রয়েছে। ময়মনসিংহের মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি ৪৩ লাখ টাকার অভিযোগ করেছেন। এই টাকা ৫ জন ব্যক্তির কাছ থেকে এনে দিয়েছিলেন মাহমুদ। গাজীপুরের তাজুল ২৩ জনের সাড়ে চার লাখ টাকা, ইব্রাহিম নামের আরেক ব্যক্তি সাতজনের ১৭ লাখ, মঞ্জুরুল ১৩ জনের ৪৮ লাখ, জামালপুরের মিজান ২৮ জনের দুই লাখের বেশি টাকা, বিল্লাল হোসেন গাইবান্ধার তিনজনের ১৩ লাখ টাকা, ফখরুল আলম ভূঁইয়ার ৪ লাখ ৫০ হাজার, নোয়াখালীর আরেক ব্যক্তির ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছেন। এর বাইরে আরো অনেক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন। তবে তারা কোনো মামলা করতে চান না। সিটিটিসি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আলী হাসান আসকারী জেলে থাকলেও তার এজেন্টরা এখনো সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। আলী হাসান গ্রেপ্তার হয়েছেন এমন খবর পাওয়ার পর অনেক ভুক্তভোগী আসকারীর এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু তার এজেন্টরা ভুক্তভোগীদের মামলা না দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, মামলা করলে টাকা মিলবে না। আসকারী জামিনে মুক্তি পেলেই তাদের টাকা পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, আসকারীর এজেন্টরা অনেকেই তাদের অবস্থান ও মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করেছেন। তাই এখনই তাদেরকে ধরা সম্ভব নয়। মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদেরকেও ধীরে ধীরে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ইকোনমিক ক্রাইম ও হিউম্যান ট্রাফিকিং বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নবাব বংশের উত্তরসূরি পরিচয় দেয়া এই আলী হাসান আসকারীর প্রতারণা দেশজুড়ে বিস্তৃত। সে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাদের কাছে বহু ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন। এখন পর্যন্ত ছয় কোটি টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে এমন তথ্য পেয়েছি। আমরা ভুক্তভোগীদের মামলা করার পরামর্শ দিচ্ছি। সিটিটিসি’র এই কর্মকর্তা আরো বলেন, তার আসল পরিচয় খোঁজার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। ধারণা করছি, গ্রেপ্তারকৃত চারজনই আপন ভাই। আমরা ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তাদের পরিচয় বের করবো।
মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়, নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নাতি পরিচয় দিয়ে আলী হাসান আসকারী ২০১৮ সালের ২৩ মে স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি দেয়ার কথা বলে তিন দফায় ব্যাংক ও নগদে ১৩ লাখ টাকা নেয়। চাকরি দিতে না পারলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে নানা টালবাহানা করতে থাকে। তার সঙ্গে প্রতারণায় অংশ নেয় তার স্ত্রী মেরিনা আক্তার হেনাসহ আরও কয়েকজন।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জিহাদ ফকরুল আলম খান জানান, আসকারী ও তার স্ত্রী-শ্যালকসহ তিনজনের নামে প্রতারণা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মামলার ২নং আসামি ও আসকারীর শ্যালক রায়হান উদ্দীন জনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নাতি পরিচয় দিয়ে আলী হাসান আসকারী বছর তিনেক আগে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের সবুজপাড়ার হাতেম আলীর মেয়ে মেরিনা আক্তার হেনাকে ২৫ কোটি টাকার মিথ্যা কাবিনে বিয়ে করেন। আলী হাসান আসকারী যখনই চুয়াডাঙ্গার শ্বশুরবাড়ি আসতেন তখনই মহল্লায় উৎসবের আমেজ দেখা যেত। মাস খানেক আগে মেরিনা আক্তার হেনা কন্যা সন্তান প্রসব করেন। ওই সময় মেয়েকে দেখতে আলী হাসান আসকারী চুয়াডাঙ্গায় আসেন। এলাকায় উন্নতমানের খাবারও বিতরণ করেন। এরপরই ২৯ অক্টোবর প্রতারণার অভিযোগে আসকারী ঢাকায় গ্রেফতার হলে অনেকের ভুল ভাঙে। মাথায় হাত ওঠে দামুড়হুদার বিষ্ণুপুর গ্রামের সহিদুল ইসলামের ছেলে রফিকুল ইসলামের। কারণ তিনিও প্রতারিত হয়েছেন। রফিকুল ইসলামের বোনকে স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি দেয়ার নাম করে তিন দফায় মোট ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আলী হাসান আসকারী।
রফিকুল বলেন, ‘মেরিনা আক্তার হেনা আমার নিকটাত্মীয়। আমার বোনের চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন। একদিন মেরিনা আক্তার হেনা বলেন, আমার স্বামী নবাব পরিবারের ছেলে। দেশের সরকারি সব দফতরেই তার হাত রয়েছে। সহজেই চাকরি দিতে পারবে। এরপর আসকারী, হেনা ও হেনার ভাই জনি চাকরির জন্য টাকা দাবি করে। স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রথমে ৭ লাখ টাকা নেন আসকারী। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দেই। পরে দু’দফায় মেরিনা ও জনির হাতে আরও ৬ লাখ টাকা দেই। টাকা নিয়েও চাকরি দিতে না পেরে দিনের পর দিন ঘোরাতে থাকেন তারা। এরই মধ্যে প্রতারণার মামলায় আসকারী ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাই।’
উল্লেখ্য, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলী হাসান আসকারী তার স্ত্রী মেরিনা আক্তার হেনাকে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য পদে দাঁড় করিয়ে দেন। সেই সময় চুয়াডাঙ্গার জামাই হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান আসকারী। মুসলিমলীগ মনোনীত প্রার্থী হেনা হারিকেন মার্কা নিয়ে নির্বাচনে নামলেও ভোট পেয়েছিলেন হাতেগোনা কয়েকটি।
