
সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভারতে নির্বাচন কমিশন গঠনে যুগান্তকারী রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং ভারতের প্রধান বিচারপতিসহ একটি প্যানেল দ্বারা নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করা হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং দু’জন নির্বাচন কমিশনার মূলত সারা দেশে নির্বাচনের তদারকি করেন। নতুন রায় অনুযায়ী একটি কমিটির পরামর্শে তাদের নিয়োগ করা হবে। এনডিটিভি। বিচারপতি কে এম জোসেফের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছেন, ‘নির্বাচন নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু হওয়া উচিত এবং এর বিশুদ্ধতা বজায় রাখা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশনের সাথে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।’ সর্বসম্মত রায়ে বলা হয়, ‘গণতন্ত্রে নির্বাচনের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে, অন্যথায় তা বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে।’ সুদূরপ্রসারী এই রায়ের অর্থ হলো নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সচিবালয়, নিয়ম প্রণয়নের ক্ষমতা, স্বাধীন বাজেট এবং অভিশংসন থেকে সমান সুরক্ষা থাকবে। নির্বাচন কমিশন এখন তহবিল এবং অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর আধিকারিক ও আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে যাওয়ার পরিবর্তে ভারতের একত্রিত তহবিল থেকে সরাসরি তহবিল তুলতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট আগের শুনানিতে ‘ন্যায্য ও স্বচ্ছ ব্যবস্থার’ ওপর জোর দিয়েছিল যাতে ‘সেরা মানুষ’কে দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং দু’জন কমিশনারকে ছয় বছরের মেয়াদের জন্য নিয়োগ করেন এবং তারা সাধারণত সাবেক আমলা। বিদ্যমান প্রক্রিয়াটি ‘নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছা ও অভিনবত্ব’ দ্বারা চালিত হয়েছিল, এই যুক্তি দিয়ে পিটিশনগুলো দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য কলেজিয়াম-সদৃশ ব্যবস্থা চেয়েছিল।
পিটিশনগুলোতে বলা হয়েছে, সিবিআই ডিরেক্টর বা দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী লোকপালের নিয়োগের বিপরীতে, যেখানে বিরোধী দলের নেতা এবং বিচার বিভাগের বক্তব্য রয়েছে, কেন্দ্র একতরফাভাবে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ করেছে।
সুপ্রিম কোর্ট সাবেক আইএএস অফিসার অরুণ গোয়েলকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘বিদ্যুৎ গতিতে’ নতুন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রকে প্রশ্ন করেছে এবং নিয়োগসংক্রান্ত মূল ফাইলগুলো দেখতে বলেছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় কিভাবে চারটি নাম শর্ট লিস্টেড করেছে তা জানতে চেয়ে ফাইলটি খতিয়ে দেখেন সুপ্রিম কোর্ট। এমনকি এই নামগুলোর মধ্যে কেন্দ্র এমন ব্যক্তিদের বাছাই করেছিল যারা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছয় বছরও পাবেন না।
উল্লেখ্য, ভারতের নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের মেয়াদ ছয় বছরের। নির্বাচন কমিশন একটি স্বায়ত্তশাসিত সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ হলেও দেশটির বিরোধী দলগুলো নিয়মিত এই সংস্থাকে ক্ষমতাসীন দলের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে বলে অভিযোগ করেছে। যদিও দেশটির সাংবিধানিক এই সংস্থা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বর্তমানে ভারতের প্রেসিডেন্ট, যিনি মূলত সরকারের আদেশ মেনে চলেন, তিনিই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দুই কমিশনারকে ছয় বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করেন।
সাধারণত দেখা যায়, সরকারের অনুগত ও ঘনিষ্ঠ আমলাদেরই এই পদে নিযুক্তি দেয়া হয়। এইভাবে মনোনয়ন নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। ইদানীং কমিশনের বিরুদ্ধে শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছেন ভারতের বিরোধী নেতারা। এ ছাড়া আছে কিছু বিতর্কিত নিয়োগও। সম্প্রতি অরুন গোয়েল নামের এক সাবেক কেন্দ্রীয় আমলাকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ তিনি নিয়োগের মাত্র একদিন আগেই তার পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এই ‘বিদ্যুৎগতির নিযুক্তি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
ভারতে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্ত করার এই চর্চা কয়েক দশকের পুরনো। নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্ত করার পুরনো এই বিধি বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থে হওয়া পিটিশনের পক্ষে লড়াই করা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সুপ্রিম কোর্টের নতুন রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্য একেবারে অপরিহার্য এবং সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য, আপনি এমন একটি ব্যবস্থা রাখতে পারবেন না; যেখানে সরকার একা নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেয়।’ ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরাইশি বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত দাবি অবশেষে পূরণ হচ্ছে।’ সুপ্রিম কোর্টকে উল্লেখ করে টুইটারে এক টুইটে তিনি বলেন, অবশেষে সুপ্রিম কোর্টে জয় হয়েছে। দুই দশক ধরে দাবিটি ঝুলে আছে বলে টুইটে লিখেছেন তিনি।
গত শতকের ১৯৯০-এর দশকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন কমিশনের মান ও নিরপেক্ষতাকে যে উচ্চতায় স্থাপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা বজায় থাকেনি। ইদানীং কমিশনের বিরুদ্ধে শাসক দলের প্রতি চূড়ান্ত পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী নেতারা। সম্প্রতি শিবসেনার নাম ও প্রতীক বিক্ষুব্ধ শিন্ডে গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়ায় নির্বাচন কমিশন বিরোধীদের তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে। উদ্ধব গোষ্ঠী কমিশনকে ‘দলদাস ও স্তাবক’ বলে অভিহিত করেছেন। গত ১০ বছর ধরে নির্বাচনী প্রচারে ঘৃণা ভাষণ দেয়ার বহু অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও সেই অভিযোগ করেছিলেন বিরোধীরা। কমিশন তাদের ভাষণে কোনো ত্রুটি খুঁজে পায়নি।
এই রায়ের পর নির্বাচন কমিশন এক স্বাধীন সচিবালয় পাবে। স্বাধীনভাবে নিয়মনীতি তৈরি করতে পারবে। নিজেদের বাজেট স্বাধীনভাবে তৈরি করতে পারবে। তহবিলের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। সরাসরি কেন্দ্রীয় ট্রেজারি থেকে টাকা তোলার ক্ষমতা পাবে।