ইপেপার । আজ সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:১৪:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অগাস্ট ২০১৮
  • / ৮৩৫ বার পড়া হয়েছে

খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশের ব্যাংকিং খাত। দুশ্চিন্তার বিষয় হল, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বর্তমানে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল হওয়ার কারণেই মূলত খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করার কারণে সেখানেও খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের ভারে বিপর্যস্ত ১৪টি ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে আদায়অযোগ্য কুঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা- এটি মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ চিত্র দেশের ব্যাংকিং খাত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সর্বোপরি অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত। খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। এছাড়া যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রদেয় নতুন ঋণও খেলাপির পাল্লা ভারি করছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঋণ যাতে কুঋণে পরিণত না হয়, সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর সতর্ক থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে অসৎ কর্মকর্তাদের দাপট ও আধিপত্য রোধের বিষয়েও নজর দেয়া উচিত। দেখা গেছে, অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি খেলাপি ঋণের প্রসার ঘটায়। মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পর তা খেলাপিতে পরিণত করার প্রবণতা শুরুতেই রোধ করা গেলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঝুঁকি এড়ানো সহজ হবে। দুঃখজনক হল, ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি, যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। বস্তুত ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে আমাদের সমাজে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহিতার পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা গেলে খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য অনিয়ম হ্রাস পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, খেলাপি ঋণ কাক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা ব্যাংকগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে ব্যাংকিং খাতে অবশ্যই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাধারণত খেলাপি ঋণের প্রায় পুরোটাই মন্দঋণে পর্যবসিত হওয়ায় তা লোকসান বা পুঁজি ঘাটতি হিসেবে দেখানো হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এ ধরনের ঘাটতি মিটিয়ে থাকে সরকারি তহবিল থেকে টাকা গ্রহণ করে, যা মূলত জনগণের দেয়া ট্যাক্স। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে এ ঘাটতি মেটায়। নিয়মানুযায়ী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে গড়ে ২৫ ভাগ মূলধন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয় যা ‘প্রভিশন’ নামে পরিচিত। প্রভিশনে রাখা অর্থ ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারে না বিধায় ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোর ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর কুফলও সাধারণ গ্রাহকদের বইতে হয়, যা অনাকাক্ষিত। ব্যাংকগুলোর দেয়া ঋণ যাতে কুঋণে পরিণত না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। এজন্য অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে খেলাপি ঋণের বিস্তার রোধ ও অনাদায়ী ঋণ আদায়ে সরকার কঠোর হবে, এটাই প্রত্যাশা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি

আপলোড টাইম : ০৯:১৪:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অগাস্ট ২০১৮

খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশের ব্যাংকিং খাত। দুশ্চিন্তার বিষয় হল, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বর্তমানে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল হওয়ার কারণেই মূলত খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করার কারণে সেখানেও খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের ভারে বিপর্যস্ত ১৪টি ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে আদায়অযোগ্য কুঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা- এটি মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ চিত্র দেশের ব্যাংকিং খাত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সর্বোপরি অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত। খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। এছাড়া যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রদেয় নতুন ঋণও খেলাপির পাল্লা ভারি করছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঋণ যাতে কুঋণে পরিণত না হয়, সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর সতর্ক থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে অসৎ কর্মকর্তাদের দাপট ও আধিপত্য রোধের বিষয়েও নজর দেয়া উচিত। দেখা গেছে, অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি খেলাপি ঋণের প্রসার ঘটায়। মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পর তা খেলাপিতে পরিণত করার প্রবণতা শুরুতেই রোধ করা গেলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঝুঁকি এড়ানো সহজ হবে। দুঃখজনক হল, ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি, যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। বস্তুত ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে আমাদের সমাজে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহিতার পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা গেলে খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য অনিয়ম হ্রাস পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, খেলাপি ঋণ কাক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনা ব্যাংকগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে ব্যাংকিং খাতে অবশ্যই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাধারণত খেলাপি ঋণের প্রায় পুরোটাই মন্দঋণে পর্যবসিত হওয়ায় তা লোকসান বা পুঁজি ঘাটতি হিসেবে দেখানো হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এ ধরনের ঘাটতি মিটিয়ে থাকে সরকারি তহবিল থেকে টাকা গ্রহণ করে, যা মূলত জনগণের দেয়া ট্যাক্স। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে এ ঘাটতি মেটায়। নিয়মানুযায়ী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে গড়ে ২৫ ভাগ মূলধন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয় যা ‘প্রভিশন’ নামে পরিচিত। প্রভিশনে রাখা অর্থ ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারে না বিধায় ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোর ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর কুফলও সাধারণ গ্রাহকদের বইতে হয়, যা অনাকাক্ষিত। ব্যাংকগুলোর দেয়া ঋণ যাতে কুঋণে পরিণত না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। এজন্য অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে খেলাপি ঋণের বিস্তার রোধ ও অনাদায়ী ঋণ আদায়ে সরকার কঠোর হবে, এটাই প্রত্যাশা।