বেসরকারি মেডিক্যালে লেখাপড়ায় ব্যয় বাড়ল,উচ্চ শিক্ষায় বৈষম্য আরও তীব্র হবে

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশসহ জাতিসঙ্ঘের সদস্য ৪৪ শতাংশ দেশে এখনো জনসংখ্যার তুলনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তারের ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সব দেশে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার থাকা উচিত। আমাদের আছে আড়াই হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের এ মুহূর্তে দেশে কমপক্ষে দেড় লাখ ডাক্তার প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে নিবন্ধিত আনুমানিক ৭৯ হাজার এমবিবিএস ডাক্তার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত। শুধু চিকিৎসক নন, দেশে উচ্চ শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির অভাব সব খাতেই প্রকট। নানাভাবে এই অভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মোচন হয়। দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা সীমিত থাকায় অনেক মেধাবীর উচ্চ শিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটত। এ সমস্যা দূর করতে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলার অনুমতি দেয়া হয়। তবে তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করা ছিল ধনিক শ্রেণী ছাড়া অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মূলত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের দেশে পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টিতে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। যাতে করে আমাদের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করতে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনা যায়। গত তিন দশকে দেখা যাচ্ছে, এ লক্ষ্য অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। এখন সাধারণ ঘরের বহু ছেলেমেয়েও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। বেসরকারি খাতে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রতিযোগিতার মুখে শিক্ষার্থী পেতে টিউশন ফি কমানোতে এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে শতাধিক মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার ছাত্রছাত্রী ডাক্তার হয়ে বের হচ্ছেন।

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে টিউশন ফিসহ সব ধরনের শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করে সরকার। এ শিক্ষাব্যয় বহন করা আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সাধারণ পরিবারের অভিভাবকের পক্ষে এখনো দুঃসাধ্য। তার ওপর এবার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষাব্যয় আরও বাড়ানো হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ (২০২২-২৩) থেকে বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের এমবিবিএস এবং বিডিএস কোর্সে ভর্তির ফি বাড়িয়েছে সরকার। ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকার ভর্তি ফি এক লাফে তিন লাখ ২৪ হাজার টাকা বাড়ানো হলো। নতুন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

এখন প্রশ্ন হলো- বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি বাড়ানো কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত? এমনিতে দেশে মুষ্টিমেয় একটি গোষ্ঠী ছাড়া সবার আয় বাড়েনি; বরং অনেকের আয় কমে গেছে। সমাজে ধনী-গরিবের আয়বৈষম্য দিন দিন তীব্রভাবে বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষা খরচ বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো- স্বল্প আয়ের পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পারিবারিক আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় তারা আর মেডিক্যাল শিক্ষা নিতে পারবেন না। এমনিতেই আগেও যারা স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে বেসরকারি মেডিক্যালে লেখাপড়া করতে আসতেন তাদের অভিভাবকদের প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে অনেক সময় জায়গা জমিও বিক্রি করতে হতো।

আমরা মনে করি, যেখানে শিক্ষা খাতে আরো সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো দরকার, সেখানে নাগরিকদের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় না নিয়ে আরো শিক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে করে বেসরকারি শিক্ষা খাতে বৈষম্য আরো বাড়বে। অর্থের জোরে ধনিক-বণিক শ্রেণি মেডিক্যাল শিক্ষা ক্রয় করার আরও সুযোগ পাবে। শিক্ষার মৌলিক অধিকারের প্রতি এটি এক ধরনের অস্বীকৃতিরই নামান্তর।