সমীকরণ প্রতিবেদন:
কূটনৈতিক তৎপরতার পর এবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আগে এমন আলোচনায় ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি। গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চেয়াপারসন খালেদা জিয়া অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে তিনি রাজনীতি করবেন কি-না সেটি তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এ ছাড়া সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ও দলটির আরেক শীর্ষ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমও জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়াকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে বিএনপিও সম্প্রতি কয়েকটি সমাবেশে খালেদা জিয়ার বিষয়টি মজবুতভাবে বলছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন একটি সমাবেশে বলেছেন, ‘দেশে পরবর্তী সরকার হবে খালেদা জিয়ার সরকার, তারেক রহমানের সরকার। এই সরকারকে হটে যেতে হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। মেশিনে নয়, জনগণ নিজের হাতে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখায় রাজনীতিতে খালেদা জিয়াকে নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রের সাথে কথা হলে তারা জানান, আসলে খালেদা জিয়ার রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। খালেদা জিয়া অসুস্থ, তার প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসা। খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, আবারো দেশের নেতৃত্ব বিএনপি সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে এবং বিএনপি সংগঠিত হচ্ছে। আগামীতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দলের প্রধান হবেন তারেক রহমান। আর খালেদা জিয়ার নির্দেশ ও পরামর্শে তারেক রহমানকে সামনে রেখে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। বিএনপি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগ নিজ থেকেই খালেদা জিয়ার রাজনীতি ও নির্বাচনের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে। অতীতে আওয়ামী লীগ স্পর্শকাতর অনেক ইস্যু সামনে নিয়ে এসে দলে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করেছে, তবে প্রায় দেড় যুগের মতো বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বড় ধরনের কোনো ফাটল ধরাতে পারেনি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের বিষয়টি সামনে নিয়ে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করলেও আওয়ামী লীগ সফল হবে না বলে মনে করছে বিএনপি।
তবে আওয়ামী লীগ ও দেশের সচেতন মহলের একটি অংশ মনে করছে, যে দলের প্রধান আদালত কর্তৃক দুতি, সে দলের প্রধানের কাছ থেকে গণতন্ত্র ও সুশাসন দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। ‘তারেক রহমান-২০০৭ সালে রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে বিদেশে গেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তার ৩০ বছর সাজা হয়েছে। মানি লন্ডারিং মামলায় সাত বছর সাজা হয়েছে। তারেক জিয়া কখনোই ঢাকায় আসবেন না। ঢাকায় এলে তাকে জেলে যেতে হবে। জেলে গেলে রাজনীতি তো দূরের কথা, কখনো নির্বাচনই করতে পারবেন না।’ অন্যদিকে একইভাবে খালেদা জিয়াও ‘দুর্নীতি’ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। সরকারের বিশেষ নির্দেশে কোভিডের সময় তিনি শর্তে মুক্তি পান। তবে এ নিয়ে বিএনপিতে ভিন্ন ভাষ্য রয়েছে, তারা দাবি করেছে খালেদা জিয়া বন্দি থেকে গৃহবন্দি রয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলে বিএনপি তথাকথিত ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত’-এর উদ্দেশে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে। এ রকম দাবি-দফা রাজনৈতিক কর্মকারে অংশ। আগেও দলটি বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল। ২০১৭ সালে ‘ভিশন- ২০৩০’ ঘোষণা করেছিল। অভিজ্ঞ মহলও বলেছে, ‘ভিশন-২০৩০’ আলোকে এবার ২৭ দফা প্রণীত হয়েছে। এটা দিয়ে রাষ্ট্র মেরামত স্বপ্ন দেখছে দলটি। অতীতে ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশ একাধারে চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লজ্জার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দুর্নীতি, লাল ফিতার দৌরাত্য, অর্থ পাচার, ঘুষ- সব মিলিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ ছিল দুর্নীতির অপর নাম। শীর্ষ পর্যায়ে হয়েছে দুর্নীতি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিএনপির এই দুই শীর্ষ ব্যক্তি কোনোভাবেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও আইনগতভাবে মোকাবিলা করবে।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম দাবি করেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা দেয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতে তাকে বাসায় নেয়া হয়েছে। এ মুচলেকা খালেদা জিয়া নিজে দিয়েছেন, নাকি তার পরিবারের সদস্যরা দিয়েছে, তা এই সংসদ সদস্য তার বক্তব্যে পরিষ্কার করেননি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপির রাজনীতি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য আর তারেক রহমানের শাস্তি নিয়ে আবর্তিত। এর বাইরে তারা যেতে পারছে না। এটি তাদের জন্য দুঃখজনক। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে মনে হয়, তারা খালেদা জিয়ার মুক্তি নয়, বন্দিদশা আর স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতিই করতে চায়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চেয়াপারসন খালেদা জিয়া অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চেয়াপারসন খালেদা জিয়া অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে তিনি (খালেদা জিয়া) রাজনীতি করবেন কি-না সেটি তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে (রাজনৈতিক প্রক্রিয়া) সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না বলেও জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, দুই বছরের দুপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, সেটি সংবিধানে বলা আছে। এটি নতুন করে বলতে হবে না। জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান। বিএনপি চেয়ারপারসন গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী অসুস্থ, চিকিৎসাধীন। সরকারের নির্বাহী আদেশে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি কখন কিভাবে রাজনীতি করবেন তা চেয়ারপারসনের নিজের সিদ্ধান্ত। আমাদের লক্ষ্য একটাই— উনার সুস্থতা ও মুক্তি দেশনেত্রীর মুক্তি হলেই গণতন্ত্রের মুক্তি হবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ‘ক্ষমতাসীন সরকারের নির্দেশে খালেদা জিয়াকে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। মূলত সরকার খালেদা জিয়াকে রাজনীতির বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র করছে। আজকে (গতকাল) আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে তিনি বলার কে? খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন কিংবা না নেবেন সেটির ‘সময়’ বলে দেবে। তবে আমরা আপাতত এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছি না।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘সাময়িক মুক্তি পেলেও আইনগতভাবে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না। তাই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই দল চালাচ্ছেন, আর তিনি তো খারাপও চালাচ্ছেন না। এর মধ্যে চেয়ারপারসন সুস্থ হয়ে গেলে তো কথাই নেই। খালেদা জিয়া যদি পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান তাহলে দলে কে প্রধান হবে এটি বিএনপির নিজস্ব বিষয়। তবে আমরা তো এই সরকারের অধীনে নির্বাচনেই যাবো না। আমাদের দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয় আওয়ামী লীগের ভাবাটাও বোকামি।’