স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা নয়
শীতকাল যতই এগিয়ে আসছে দেশে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ততই জোরালো হচ্ছে। নতুন করে শুরু হয়েছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। চলছে নতুন করে কড়াকড়ি আরোপের আয়োজন। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটেনে আবার মাসব্যাপী লকডাউন শুরু হয়েছে। এ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও সব রেস্তোরাঁ, ব্যায়ামাগার, পানশালা এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনে জরুরি নয় এমন দোকানপাট, মার্কেট, শপিংমল চার সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। শুধু ব্রিটেন নয়, ইউরোপের অনেক দেশেই করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরু হয়েছে। স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স নতুন করে সংক্রমণের শিকার হয়েছে। গত পাঁচ সপ্তাহে ইউরোপের দেশগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসাবে শনাক্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গায়ের জোরে করোনা রোধের চেষ্টা বুমেরাং হয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ। তার ১৬টি নির্বাচনী সভা থেকে ৩০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ৭০০ জন। এখন এই করোনা রোধে ব্যর্থতার কারণে আজকের নির্বাচনে ক্ষমতার পাশা উল্টে যায় কি না এমন সম্ভাবনাও জোরালো হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশেও করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সে মতে সরকারিভাবে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঘরের বাইরে সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে সরকার। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ কার কী ভূমিকা হবে সে বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হয়। সেসব নির্দেশনার মধ্যে যেগুলো খালি চোখে দেখা যায়, যেমন সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করা, সেগুলোর একটিও কার্যকর হয়নি। শীতের আগমনে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিমানবন্দরসহ সব প্রবেশপথে বাধ্যতামূলক করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিনে রাখতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এই নির্দেশনা কড়াকড়িভাবে মানা হচ্ছে না। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ধর্ম মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল, দেশের সব মসজিদসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রতিদিন অন্তত দু’বার করে মাস্ক পরার রাষ্ট্রীয় আদেশের বিষয়টি বলতে। তারা সেটি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই নেয়নি বলে খবর দিয়েছে গণমাধ্যম। মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তেমন কোনো মোবাইল কোর্ট এখন পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়নি। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে মাস্ক ছাড়া প্রবেশ না করা এবং সেবা না দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। সেটিও কার্যকর হয়নি।
অথচ করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উত্তম উপায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া, জনে জনে দূরত্ব বজায় রাখা। এর কোনো বিকল্প নেই। মাস্ক পরলে ৮০ ভাগ নিরাপদ থাকা যায়। এটি অনেকটাই সুরক্ষা দেয়। বিশ্বের বিজ্ঞানীদের দেয়া সর্বশেষ তথ্য হলো, করোনায় আক্রান্ত ৮২ ভাগ মানুষের মধ্যে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। আমাদের দেশেও এমনটাই ঘটছে। করোনা পজিটিভ কিন্তু লক্ষণ নেই এমন অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মাস্ক পরার বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা সেসব মানছি না। বরং নানা অজুহাত খাড়া করে এড়িয়ে যাচ্ছি। মাস্ক ছাড়াই ঘরের বাইরে আসছি, মেলামেশা করছি অবাধে। এই গাছাড়া ভাব মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে নাগরিকদের। কারণ করোনাভাইরাস নির্মূল হয়েছে এমন নয়। এর প্রকোপও খুব কমেছে তা বলা যাবে না। এখনো প্রতিদিন প্রায় ২০ জন করে কোভিড-১৯ রোগী মারা যাচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে অনেক মানুষ। সোমবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ১৮ জন, শনাক্ত হয়েছে প্রায় ১৬০০ জন। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছয় হাজার ছুঁই ছুঁই। শতাধিক চিকিৎসক, রাজনীতিক, আমলা, শিল্পপতি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ নানা স্তরের শত শত বিশিষ্টজন অকালে চলে গেছেন, যাদের আমরা কখনো ফিরে পাবো না। রাজনীতিকদের বক্তৃতাবাজিতে করোনার উপসম হয় না। এর বড় উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আমাদের এখানেও সরকারের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ হবে না। তারা যতই ব্যর্থ হন না কেন সেটি স্বীকার করা তো দূরের কথা ১০০ ভাগ সাফল্যের দাবিই তারা করবেন এবং করছেন। সতর্ক থাকতে হবে জনগণকেই। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করার পরিণতি গুরুতর হতে পারে।
