বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষা : এদেশের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ইংরেজিতে দুর্বল
-শামীম হোসেন মিজি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক -ডুসাক
মেধা তালিকায় থেকেও ইংরেজিতে শর্ত পূরণ না করায় শত শিক্ষার্থীর ভর্তির স্বপ্ন ভঙ্গ । ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। বিশ্বের প্রায় ৫৪-৫৫ টা দেশে ইংরেজি সরকারি ভাষা হিসাবে চালু আছে। শুধু দেশ নয় বিশ্বের বড় বড় সংগঠন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথসহ প্রায় সব সংগঠনের পরিচালনার প্রধান ভাষা ইংরেজি। বাংলাদেশেও শিক্ষার দ্বিতীয় মাধ্যম ইংরেজি। ব্রিটিশ সরকারের সময় এদেশের মুসলমানরা ইংরেজি বে- ধর্মীর ভাষা বলে শিখতে অবহেলা করত, অপরদিকে অন্যন্যা সম্প্রদায়ের লোক ইংরেজি শিখে বিভিন্ন সরকারি চাকরি পেতে লাগলো। ইংরেজি শিক্ষার বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয় পূর্বপুরুষদের সেই সাম্প্রদায়িক রক্ত এখনো আমাদের টানছে। তখন এদেশের কিছু মুসলিম উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন। মুসলমানরা ইংরেজি শিখতে শুরু করলো, তবে শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য। এই চিন্তার জন্য ১৮৩৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষার শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়ে নি ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগর, জগন্নাথ, রাজশাহী প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষায় ইংরেজিতে ফেলের হার ৯২-৯৩% । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় ৯৮% ফেলের রেকর্ড ও আছে। আপনারা জেনে কষ্ট পাবেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থী মফস্বলের । আবার শহরের শিক্ষার্থীরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েও এডভান্স ইংলিশে পরিক্ষা দিতে ভয় পাচ্ছে ! ঢাবির নিয়ম ছিল বিষয় হিসাবে ইংরেজি পেতে হলে এডভান্স ইংলিশ অংশ পরিক্ষা দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দমত সাবজেক্ট নিতে হলে ইংরেজিতে ভাল নম্বর থাকতে হবে ।
এ বছর শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় ইংরেজিতে কন্ডিশন অনুযায়ী নম্বর তুলতে না পারায় অনেক বিষয় খালি পড়ে আছে – ইংরেজি, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, দর্শন, লোকপ্রশাসনের তথ্যবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি, শান্তি ও সংঘর্ষ, ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার, পপুলেশন সাইন্স, ডিসেস্টার ম্যানেজমেন্টে সিট ফাঁকা যাচ্ছে ।
চুয়াডাঙ্গা থেকে কিছু ছেলে-মেয়ে ইংরেজিতে কন্ডিশন না থাকায় কোন বিষয় না পেয়ে আমার কাছে এসেছিল। আশ্চর্যের বিষয় তাদের অনেকে এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই গোল্ডেন প্লাস পেয়েও ইংরেজিতে কোন রকম পাশ মার্ক তুলেছে। যাতে উর্দু, পালি, ফার্সি পাওয়া সম্ভব। এ বছর ইংরেজির শর্ত পূরণ করতে না পারায় এ বিষয়গুলো ২৩০০ সিটের মধ্য ১৫০০ জন পর্যন্ত না যেতেই উর্দু, পালি, ফার্সি ও শেষ ! এখন যেগুলোতে ইংরেজিতে শর্ত ৩০ নম্বরের মধ্য ১২ পাওয়ার শর্ত রয়েছে সেগুলো নেওয়ার যোগ্যতা সম্পূর্ণ শিক্ষার্থী নেই। অগত্য সিট খালি পড়ে আছে, এবং অনেক শিক্ষার্থীর ঢাবিতে পড়ার স্বপ্ন স্বপ্নতেই পরিণত হয়েছে। তাহলে শিক্ষা বোর্ড যাদের মেধাবী বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে তাদের ইংরেজি শিক্ষায় এ অবস্থা কেন ? ১২ বছর একটি ভাষা পড়ার পরেও ভাষার প্রাথমিক পরিক্ষায় কেন ফেল করছে ?
আমি নিজেও গ্রামের ছেলে, আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বললে – ইংরেজি ভীতিটা আসলে পরিবার, শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে ।
গ্রামের বাবা-মায়েরা সাধারণত অল্প শিক্ষিত হয়, যখন শিশুকে অক্ষর জ্ঞ্যান দেয়, তখন প্রতিদিন বই খুলেই বাংলা বর্ণমালা আগে পড়ায়। পরিবারের এই অবচেতন গুরুত্ব তার মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। বিদেশী ভাষা হওয়ার দরুন ইংরেজিকে দূরে রাখতে রাখতে তাতে একরকম ভীতি সৃষ্টি হয়। তারপর সাহজে, সল্প সময়ে আয়ত্বের জন্য শিক্ষকের নিকট টিউশনি পড়ে ।
অনেক শিক্ষক নিজস্ব উদ্যোগে ইংরেজি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করেন। এই সিলেবাস মুখস্ত করেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়। যখন সিলেবাস থেকে প্রশ্ন আসে না তখন তারা ফেল করে। কেননা এইসব শিক্ষার্থীর জ্ঞান এই সিলেবাসের মধ্যেই আবদ্ধ। আমরা এক ” এ টি স্টল ” আর ” ইয়োর ফেভারিট টিচার্স ” এমন কিছু প্যারাগ্রাফ ও রচনা মুখস্ত করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পাড় করে দিয়েছিলাম । মুখস্ত বিদ্যা আর
ইংরেজি ভালোভাবে বুঝতে না পারাই ফেল করার কারণ বলে মনে করি। কেননা আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখস্ত বিদ্যায় পারদর্শী। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মুখস্ত করার জন্যই উপদেশ দিয়ে থাকেন। এমনকি ক্লাসে শিক্ষকরা সেই মুখস্ত করা পড়া নেন মুখে। এতে করে শিক্ষার্থীরা মুখস্ত পাঠ ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খায়।
শিক্ষকের দোষ, কি করে দেয় ? আসলে দোষ আমাদের চাকরি ব্যবস্থার,
শিক্ষা ব্যবস্থায় – ভাল কলেজে ভর্তি করতে গেলে নিদিষ্ট রেজাল্ট লাগে, আবার কিছু চাকরিতে জিপিএ ও সি জিপিএ নির্ধারণ করে দেয় । তাই অভিভাবকরা শিক্ষককে বলে ” যেগুলো পরিক্ষায় আসবে, সেগুলো পড়াবেন ” ।
পড়াশোনা এখন চাকরিভিত্তিক ও রেজাল্টের প্রতিযোগিতা ভিত্তিক হয়ে পড়েছে, তাই একটি ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেই শিক্ষার্থীদের হাবুডুবু অবস্থা।
ইংরেজি শুধু ভাষা নয় ইংরেজি এখন প্রযুক্তি। প্রযুক্তির যুগে প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করতে হলে ইংরেজি অপরিহার্য। শিক্ষার বিশ্বমান বজায় রাখতে হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সকলকে ইংরেজি শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ।
চুয়াডাঙ্গাতে কোন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল -কলেজ নেই । আজ আমাকে ইংরেজির গুরুত্ব বাংলা পত্রিকায় লিখতে হচ্ছে, কারন জেলায় ১০ টি বাংলা সংবাদপত্র থাকলেও একটি দৈনিক পত্রিকা বাদ দিলাম, মাসিক কিংবা সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা নেই।
শিক্ষার বিশ্বমান বজায় রাখতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক, ও অর্থনৈতিক দুরুত্ব ঘুচিয়ে জেলার ইংরেজি শিক্ষার হার বাড়াতে সামাজিক, রাজনৈতিক সকল সগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রতি বছর নতুন নতুন সৃজনশীল প্রশ্ন করতে হবে যাতে মুখস্ত করার প্রবণতা দূর হয় ।
এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে শিক্ষকদের তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। কেননা জাতি গঠনের কারিগর এই শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের মুখস্ত বিদ্যার মতো আবদ্ধ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন ।