
সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভারতের ঝাড়খণ্ডের আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে নানা সমালোচনা। ক্যাপাসিটি চার্জ, কয়লার দামসহ এখনও অনেক ইস্যুর সমাধান হয়নি। বিদ্যুতের সম্ভাব্য দাম কী হবে তাও চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে ভারত থেকে শুরু হলো আদানির বিদ্যুৎ আসা। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা ৩৮ মিনিটে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসা শুরু হয়। চলতি অর্থবছর কেন্দ্রটি থেকে সর্বোচ্চ ৭৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় পড়বে গড়ে প্রতি ইউনিটে ছয় টাকা ৩৮ পয়সা। যদিও আদানির বিদ্যুতের দাম পড়বে ইউনিট প্রতি ১৬ টাকা ৩১ পয়সা। তবে এটি কয়লার দাম কমানোর পর। তবে কয়লার দাম না কমানো হলে এ দাম পড়বে ২২ টাকার বেশি। এদিকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এ কেন্দ্র থেকে বছরে কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতেই হবে। না হলে জরিমানা গুনতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি ক্যাপাসিটি চার্জ তো রয়েছেই। যদিও দেশীয় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ ধরনের গ্যারান্টি বা জরিমানার বিধান নেই।
চুক্তির ৩.১-এর (বি) ধারায় বলা হয়েছে, পিডিবিকে চুক্তির প্রত্যেক বছর কেন্দ্রটির বিদ্যমান সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে, যা ‘মিনিমাম অফটেক কমিটমেন্ট’ হিসেবে বিবেচ্য হবে। যদি বাংলাদেশ তা কিনতে ব্যর্থ হয় তাহলে পিডিবির পক্ষ থেকে আদানি পাওয়ারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ক্ষতিপূরণের মধ্যে থাকবে আদানির কয়লার দাম, কয়লা পরিবহন ব্যয় ও বন্দরে কয়লা খালাস ব্যয়, যা আদানি কয়লা সরবরাহ চুক্তি, কয়লা পরিবহন চুক্তি ও কয়লা হ্যান্ডলিং চুক্তির আওতায় বহন করবে। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে গত ডিসেম্বরে দুটি পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট। উভয় প্রতিবেদনে আদানির বিদ্যুৎকে ব্যয়বহুল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ না কিনলেও বছরে আদানি ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে ৪০ দশমিক ৫০ কোটি ডলার।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দামের ইস্যুও সমাধান হয়নি। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আদানির প্রতিনিধি দল এ নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশে এসেছিল। সে সময় কয়লার দাম কমানোর বিষয়ে সম্মত হয় দলটি। এ বিষয়ে উভয় পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বৈঠকে একমত হয়। এ সময় আদানির প্রতিনিধিদল জানায়, তারা কয়লার দাম নির্ধারণ নিয়ে চুক্তি সংশোধনের বিষয়ে পিডিবির অবস্থান আদানির শীর্ষ নির্বাহীর কাছে তুলে ধরবে। পিডিবির তথ্যমতে, উš§ুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গত সেপ্টেম্বরে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনা হয়। এতে দাম পড়ে প্রতি মেট্রিক টন ২৩৭ ডলার। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনার দর প্রস্তাব জমা পড়েছে চলতি মাসে। এতে প্রতি মেট্রিক টনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ২৩২ ডলার। অথচ আদানি গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম প্রস্তাব করেছে ৪০০ ডলার। অর্থাৎ রামপালের প্রায় দ্বিগুণ দাম প্রস্তাব করেছে আদানি। কয়লার দাম বাড়তি ধরার কারণে আদানি বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবি মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দেয়া বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। চুক্তির শর্তের কারণে আরও সুবিধা পাবে আদানি। চুক্তির ১৩.১-এর (জি) ধারার (৪) উপধারায় এ-সংক্রান্ত শর্ত রয়েছে। এতে দেখা যায়, ৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে (পূর্ণ ক্ষমতা) যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে, তবে পিডিবি যদি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনে তাহলে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে। আবার ৬০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে (অপূর্ণ ক্ষমতা) যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে, তবে পিডিবি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনলে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তিতে কম লোডে বিদ্যুৎকেন্দ্র চললেও কয়লার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, ৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে আদানি হিট রেট পাবে ২৪৩২; এভাবে লোড যত নিচের দিকে যাবে বা কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, তত বেশি হিট রেট পাবে আদানি। গড়ে সারা বছর যদি ৫০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে বা স্থাপিত ক্ষমতার অর্ধেক চালায় আদানি, তাহলে তারা হিট রেট পাবে ২৫৫৫। অথচ পায়রাতে হিট রেট ফ্ল্যাট বা সমান ২৩০০। কম বা বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে পায়রাতে কয়লা ব্যবহার কম বা বেশি হওয়ার বিধান নেই। এতে পায়রাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৯৩.৪৮ গ্রাম কয়লার ব্যবহার হয়। অথচ আদানি প্রতি ইউনিটের জন্য পাবে ৫৫৫.৪৩ গ্রাম কয়লা।
এর বাইরে চুক্তিতে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার সিস্টেম লস ধরা হয়েছে ১.১০ শতাংশ। অর্থাৎ এক লাখ টন কয়লায় আদানি ১ হাজার ১০০ টন কয়লা নষ্ট দাবি করে তার দাম নিতে পারবে। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে সিস্টেম লসের বিধান রাখা হয়নি। পাশাপাশি কয়লার দামে কারসাজির সুযোগও রয়েছে আদানির। চুক্তিতে বলা হয়েছে, আদানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইন্দোনেশিয়ার ইনডেক্স ও নিউ ক্যাসেল ইনডেক্সের গড় ধরবে। যদি আদানি তার কেন্দ্রে ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লা ব্যবহার করে তবুও ইন্দোনেশিয়া এবং নিউ ক্যাসেল কয়লার গড় দাম আদায় করতে পারবে। আর ইন্দোনেশিয়ার ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লার দাম কম ও নিউ ক্যাসেলের ৬৩২২ ক্যালরিফিক মানের কয়লার দাম অনেক বেশি।
অন্যদিকে ভারত সরকার আইনে পরিবর্তন করে ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ২০১৯ সালে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ঘোষণা করে। এর ফলে নানা ধরনের কর ছাড় পাচ্ছে আদানি। এ সুবিধা প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে তা পিডিবিকে জানানোর কথা থাকলেও করা হয়নি। চুক্তির ১৩ ডি (আই) ধারায় তা বলা আছে। এতে আদানি ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লার দাম বেশি ধরতে পারবে, যা চুক্তির লঙ্ঘন। এদিকে আদানির চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই পিডিবির। আদানি পাওয়ার চুক্তির কোনো ধারা না মানলেও সমাধান খোঁজার জন্য সময় দিতে হবে। বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও আদানিকেই বেশি সুবিধা দেয়া হয়েছে। চুক্তিতে কেন্দ্রটির স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল সব খরচের বিনিয়োগ ঝুঁকি পিডিবির ওপর চাপানো হয়েছে। এছাড়া আদানি পাওয়ারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো কোনো ঘটনায় বিদ্যুৎ না কিনতে পারলে ক্যাপাসিটি চার্জ, জরিমানাসহ সব দায় পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। কিন্তু একই কারণে যদি আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, তবে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না। চুক্তি অনুসারে রাজনৈতিক কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা মেরামত ও এই সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় বহন করবে পিডিবি। রামপাল বা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এমন ধারা নেই। গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্ভরযোগ্য সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্যও বিশেষ সুবিধা পাবে আদানি।