শামীম হোসেন মিজি: সর্বজন স্বীকৃত বানী ” শিক্ষায় জাতির মেরুদণ্ড ” । কিন্তু সেই শিক্ষা শুধু একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকুক তা আমাদের কাম্য নয় । দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যামান আছে তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মাধ্যম হল বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা । কিন্তু অবাক হওয়ায় বিষয় এই যে, চুয়াডাঙ্গা থেকে এই দুটি ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। বর্তমান যুগ ডিজিটালের যুগ , যেখানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে উন্নতির আরও চরম শিখরে আরোহণ করছে, সেখানে আমাদের দেশের অবস্থান কোথায় !
এশিয়ার জাপান, চীন বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে উন্নতির পথে লাগামহীন ঘোড়ার মত ছুটে চলেছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চুয়াডাঙ্গা থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে মাত্র দুই জনের চান্স পাওয়ার খবর পেয়েছি, বিজ্ঞান বিভাগে প্রতিবারই প্রায় একই অবস্থা । শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় নুন্যতম পাশ মার্ক তুলতে পারছে না । বিজ্ঞান ও ব্যবসায়ী শিক্ষায় এত কম সংখ্যক শিক্ষার্থী-এর পিছনে যে কারনগুলো আছে বলে মনে করি, সেগুলো হলো- আর্থিক সংকট, দক্ষ শিক্ষকের অভাব, পর্যাপ্ত ক্লাস না হওয়া, উপযুক্ত বিজ্ঞানাগার না থাকা, পরীক্ষার ফলাফল, শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রভাব, সিলেবাসের মাত্রাতিরিক্ত চাপ, অত্যাধিক ব্যয়ভার, কোচিং নির্ভরতাা আর কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তাই মূলত বিজ্ঞানের প্রতি অনাগ্রহের প্রধান কারণ। তাছাড়া স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কিছু গাইড বই ছাড়া মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের মৌলিক কোনো বই নেই বললেই চলে। মফস্বলে বিজ্ঞান ও গণিত পড়ানোর মতো শিক্ষক কম। আর বয়স্ক যারা আছেন তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নানা কারণে মাল্টিডাইমেনশনাল শিক্ষককে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনার জন্য চাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকের দক্ষতার অভাবে সরকারের এ প্রচেষ্টার সুফল পাচ্ছে না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। দেশে কয়েক রকমের শিক্ষার কয়েকটি ক্ষেত্র দেখা যায় – মানবিক, ব্যবসায়ী শিক্ষা, বিজ্ঞান, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা। চুয়াডাঙ্গায় শিক্ষায় মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী বেশী তা আমার এই লেখায় এক লাইন আগে মানবিককে সবার সামনে স্থান দেওয়া দেখেই বুঝতে পারেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশী চান্স পায় এই মানবিক বিভাগ থেকেই। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলতেও একই চিত্র । এবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক থেকে চান্স পেয়েছে প্রায় ৪০ জন। সেখানে বিজ্ঞান ও ব্যবসায়ী শিক্ষায় যৌথভাবে ১০ জনও হবে না। চুয়াডাঙ্গা জেলা নিরক্ষরমুক্ত ১০টি জেলার একটি হলেও বিজ্ঞানযুক্ত জেলা হতে পারেনি । আর্থিক সঙ্কটের জন্য গ্রামগুলোতে গরীব অভিভাবকদের দেখা যায় ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসা শিক্ষায় ভর্তি করতে। কেউ আবার স্কুল কলেজে দিলেও মানবিক বিভাগে ভর্তি করে। কারন
বিজ্ঞান ও ব্যবসায়ী শিক্ষায় অনেক কোচিং করতে হয়, অনেক বই কিনতে হয় । এই ভীতিটা তৈরির জন্য আমি অভিযোগ করবো শিক্ষক ও প্রশাসনের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার উপর। সরকারের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নির্দেশ শিক্ষক ও প্রশাসন কেউ আমলে নিচ্ছে না । আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো ভাল মানের শিক্ষক সংকট। মফস্বলে বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষায় মানসম্মত দক্ষ শিক্ষকের এই সংকট আরও প্রকট। কারন ভাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা কেউ মফস্বলের স্কুল কলেজে যোগ দিতে চাই না। যদি সরকার এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো অন্য পেশার সাথে মিল রেখে ঠিক করে তাহলে এই সংকটের একটি সমাধান হতে পারে । যখন দেখি আমাদের শিক্ষকেরা তাঁদের বেতন কাঠামোর বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরণ অনশন করে তখন খুব কষ্ট লাগে। তাহলে যেনে শুনে এ পেশায় আশার স্বপ্ন কে দেখবে ভাবুন। সরকারকে বিজ্ঞানের বিষয় ভিত্তিক মর্যাদা সম্পন্ন চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে । শিক্ষকদের কাজ হবে, ছাত্রদের স্বপ্ন দেখতে শেখানো। একজন ছাত্রকে জ্ঞান দানের পাশাপাশি তার মধ্যে স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাও একজন আদর্শ শিক্ষকের কর্তব্য। যদি একজন ছাত্রের মধ্যে স্বপ্নের একটি বীজ বপন করা যায়, তাহলে তার মধ্যে এমনিতেই জ্ঞানের পিপাষা তৈরী হবে। তাই এখনই যদি বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি নজর দেয়া না হয়, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশের বিজ্ঞান মনস্ক জ্ঞান নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যত রকম প্রচেষ্টাই নেয়া হোক না কেন, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিলে তা কখনই ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে বিজ্ঞান বিষয়কে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক চাকরির সুযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থী ও তরুণদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করতে চাইলে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ জরুরী। জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। আমাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে পরিসংখ্যান বলছে এই ক্রমাবনতির হার এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। যা একটি জাতির পঙ্গুত্বের পূর্বাভাস। এই দুষ্টচক্র থেকে এখনই উত্তরণ না ঘটলে জাতির কপালে ঘোর অমানিশার অন্ধকার অবধারিত। তাই আমাদের সকল পেশাজীবী ও শ্রেনীর মানুষকে অংশগ্রহন পূর্বক বেশী বেশী শিক্ষা সমাবেশ করে সকলকে সচেতন করতে হবে। যদি সম্ভব হয়, দেশের বিশিষ্ট শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে অতিথি করে বিজ্ঞান বিষয় ভিত্তিক সভা সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করতে হবে। “ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশন অব চুয়াডাঙ্গা”(ডুসাক) জেলায় এবছর থেকে শিক্ষা সমাবেশের আয়োজনের সূচনা করেছে। এভাবে প্রতিটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্র-মিডিয়ার সামজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমাদের জেলার বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়নে এগিয়ে আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা রইল।