
সমীকরণ প্রতিবেদন:
তুচ্ছ ঘটনায় গত শনিবার সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় রেবাবার আন্দোলন ও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে শিক্ষার্থীরা আড়াই ঘণ্টা ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, দুই উপ-উপাচার্যসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এছাড়া ছয় দফা দাবিতে প্রশাসন ভবনের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে তারা বিক্ষোভ করেন। এছাড়া ক্যাম্পাসে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বেশ কয়েক জন সাংবাদিককে মারধর, ক্যামেরা ও ব্যাকপ্যাক ভাঙচুর করে। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে রেজিস্ট্রার আব্দুস সালাম শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী অজ্ঞাত ৫০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেছেন।
গতকাল রাতে বিশ্বিবিদ্যালয় সংলগ্ন রেল লাইনে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এরপর সারাদেশের সঙ্গে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সংঘর্ষ, পুলিশের রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল নিক্ষেপের প্রতিবাদে গতকাল সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনের সামনের জোহা চত্বরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ ছয় দফা দাবিতে প্রশাসন ভবনের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে দুই উপ-উপাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে প্যারিস রোডে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে যান উপাচার্য। এ সময় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যদ্বয় শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে স্লোগান দেয়। সেখানে উপাচার্য বেলা ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাবাস বাংলাদেশ’ মাঠে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের প্রস্তাবে রাজি হননি। শিক্ষার্থীদের দাবি, যেখানে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরেছে সেই বিনোদপুরে গিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাতে আইনগতসহ বিভিন্ন জটিলতার কথা বলে সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম এবং হুমায়ুন কবীরসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ‘সাবাস বাংলাদেশ’ মাঠের উদ্দেশ্যে সিনেট ভবনের উত্তরপূর্ব কর্নারে পৌঁছালে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের বাধা দেন। সেখানে ঠেলাঠেলি করে শিক্ষার্থীরা চারদিক থেকে তাদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি এবং বাক?বিতণ্ডা হয়। দুপুর প্রায় ২টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টা সেখানে অবরুদ্ধ ছিলেন উপাচার্যসহ অন্যরা। পরে ছাত্রলীগের সহায়তায় অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হন তারা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তারা চারদিক থেকে মানবঢাল তৈরি করে উপাচার্যকে তার বাসভবনে নিয়ে যান। বাসভবনের গেটে গিয়েও শিক্ষার্থীরা তাদের বাধা দিলে পরে আলোচনার আশ্বাসে উপাচার্যকে বাসভবনে ঢুকতে দেওয়া হয়। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর, সদস্য সচিব আমানুল্লাহ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবিগুলো হচ্ছে—শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী স্থানীয় ও পুলিশ সদস্যদের বিচার, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়কে শতভাগ আবাসিক হিসেবে বাস্তবায়ন করা, আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপাচার্যের বাসভবনের সামনে সংবাদ সংগ্রহের সময় চ্যানেল২৪-এর ক্যামেরাপারসন জুয়েলকে ধাওয়া দেয় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। পরে তাকে ও চ্যানেল২৪-এর সাংবাদিক আবরার শাঈরকে মারধর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় তাদের ক্যামেরা ও ব্যাকপ্যাকসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। এসময় কালের কণ্ঠের ফটোসাংবাদিক সালাহউদ্দিনের ক্যামেরাও ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। আজকের পত্রিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রিপন চন্দ্র রায়সহ কয়েক জন শিক্ষার্থী-সাংবাদিকের ওপর হামলা চালান শিক্ষার্থীরা। এ সময় আরো কয়েক জন সাংবাদিককে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করা হয়। সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও ক্যামেরা ভাঙচুরের তীব্র নিন্দা জানিয়ে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, আবরার শাঈর ও জুয়েলকে মারধর করা হয়েছে। জুয়েলকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নগরীর মতিহার থানার ওসি হাফিজুর রহমান জানান, বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আব্দুস সালাম বাদী হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী অজ্ঞাত ৫০০ ব্যক্তিকে আসামি করে লিখিত এজাহার দাখিল করেছেন।
প্রসঙ্গত, শনিবার সন্ধ্যায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ বাধে। প্রায় চার ঘণ্টার ধাওয়া পালটাপালটি ধাওয়া ও সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। আগুন দেওয়া হয় বিনোদপুর বাজারের কয়েকটি দোকান ও পুলিশ বক্সে। গভীর রাতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ ও সাত প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘১১ মার্চ শনিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসের বিনোদপুর গেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কিছুসংখ্যক এলাকাবাসীর যে অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হয় তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মর্মাহত। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপাচার্যের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’