সমীকরণ প্রতিবেদন: দীর্ঘদিন ধরেই চড়া চালের বাজার। সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া চালের দাম কমতে শুরু করলে রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার অজুহাতে বাংলাদেশের বাজারে আবারো অস্থিরতা তৈরি হয়েছে পণ্যটির দামে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ফের সক্রিয় অসাধু সিন্ডিকেট চক্র। শুধুমাত্র এক ধরনের চাল রপ্তানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে ভারত, অথচ দেশে সব চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। এদিকে সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার শুল্কছাড় দিলেও সুফল মিলছে না। বেসরকারি আমদানি না বাড়ায় শুল্কছাড়ের প্রভাব পড়েনি বাজারে। জানা গেছে, আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারসহ সরকারের নানা উদ্যোগে গত দুই সপ্তাহ ধরে কমতির দিকে ছিল চালের বাজার। প্রতি ৫০ কেজি বস্তায় দাম কমেছিল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তবে গত বৃহস্পতিবার থেকে ভারত সরকার আতপ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবরে বাজার আবারো ঊর্ধ্বমুখী। গতকাল সচিবালয়ে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত এক সংলাপে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর কারণে বিভিন্ন সুযোগে চালের বাজার অস্থির হয়ে যাচ্ছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে তিন স্তরের মূল্য সংক্রান্ত তথ্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করার একটি পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনার কথা জানান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, চলতি বছর দেশে ৩ কোটি ৮৪ লাখ টন চালের উৎপাদন হবে বলেও পূর্বাভাসও দিয়েছে সংস্থাটি। গত বছর বাংলাদেশে চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৭৮ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, দেশে এখন বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫ লাখ টনের মতো। অর্থাৎ চাহিদার চেয়েও চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা ৭০ থেকে ৭৩ লাখ টন। অথচ প্রতি বছর ২৫ থেকে ২৬ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়েছে। আর এই চালের দাম বাড়াচ্ছে কে? পাইকারদের দাবি, এলসি থেকে শুরু করে দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন নওগাঁ, কুষ্টিয়া এবং বগুড়ার ৮ থেকে ১০ মিল মালিক। এরাই কলকাঠি নাড়ছেন। বাজারে মোটা চাল স্বর্ণার কেজি ৫৫ টাকা থেকে কমে ৫৩ টাকা হয়েছে। অপরদিকে মাঝারি চালের মধ্যে পাইজাম ৫৮ থেকে কমে ৫৬ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হচ্ছে। আটাশ চালের কেজি এখন ৫৭ থেকে ৫৮ টাকার আশপাশে। অপরদিকে মিনিকেটের কেজিতে কোথাও কোথাও ১ টাকা কমেছে। তা ছাড়া নাজিরশাইল ও মিনিকেটের দাম বেশির ভাগ দোকানেই অপরিবর্তিত রয়েছে। কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চালের চলমান সংকট দূর করার জন্য সবার আগে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানিতে জোর দিতে হবে। কীভাবে এবং কোন দেশ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে চাল এনে দেশের বাজারে সরবরাহ বাড়ানো যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। শনিবার ভারতের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অনিল ঠাকুর সাংবাদিকদের বলেন, এক পত্রের মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে, ভাঙা চাল (খুদ) রপ্তানি একেবারে বন্ধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ব্রাউন চালে ২০ শতাংশ ও হাস্ক নামের একটি চাল রয়েছে, তাতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে সেদ্ধ চালে কোনো শুল্ক আরোপ করা হয়নি। আগের মতো বন্দর দিয়ে শুল্কমুক্ত পণ্য হিসেবে সেদ্ধ চাল বাংলাদেশে রপ্তানি অব্যাহত থাকবে। হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত ২৩শে জুলাই থেকে বন্দর দিয়ে চাল আমদানি অব্যাহত রয়েছে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে শুধু আতপ চাল রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। সেদ্ধ চাল আমদানিতে কোনো শুল্ক আরোপ করা হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চলতি বছর বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১০ লাখ টন চাল কেনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর সরকার নিজে ১০ লাখ টন চাল ও গম চারটি দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অথচ গত ৮ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে মাত্র ৯৩ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। এতে আমদানি সুবিধার পরেও বাজারে আমদানিকৃত চালের সরবরাহ সেভাবে বাড়ছে না।
এদিকে সরকারিভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে ১০ লাখ ৩০ হাজার টন চাল ও গম কেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী। বোরো মৌসুমে ১১ লাখ ২১ হাজার ৯১০ টন সেদ্ধ চাল এবং ৫৫ হাজার ২০৮ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে এ যাবৎ কালের সর্বোচ্চ পরিমাণ চালের মজুত রয়েছে। চলতি বোরো সংগ্রহ অভিযানে গত সোমবার পর্যন্ত ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৫৩১ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। কাওরান বাজারের মেসার্স রনি রাইস এজেন্সির ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়ানো হয়। কাওরান বাজারের বেশির ভাগ চাল মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট থেকে আসে। সেখানে সকালে এক দাম থাকে, বিকালে আরেক দাম। এমনও হয় যে, ফোনে বুকিং দিয়ে আড়তে গেলে বলা হয় চাল নেই। মোবাইল কোর্ট অভিযান চালালে এরা আড়ত রেখে পালিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলে আবারো চলে আগের মতো। এভাবেই চলছে।
