
যদিও বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রতিক হালহকিকত দেখে এ কথা বলার উপায় নেই। যারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কাণ্ডারি হিসেবে হাল ধরে আছেন, তাদের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড এত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, তা না বলাই ভালো। তবে তিন দিন আগে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিয়ে যা ঘটল; সে সম্পর্কে কিছু বলতে হচ্ছে। কারণ, এ পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে পরে স্থগিত করার মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বিষয়টি আবার উৎকটভাবে সর্বসাধারণের সামনে এসেছে।এবার পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিল। অবশ্য পরীক্ষায় অংশ নেয় চার লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ জন শিক্ষার্থী। বাকিরা নিবন্ধন করেও পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। বৃত্তির মোট কোটা ছিল ৮২ হাজার ৫০০টি। প্রাথমিক বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি মাসে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। সচিবালয়ে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে মেধা কোটায় বৃত্তি পায় ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ কোটায় পায় ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন। কিন্তু ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণ দেখিয়ে একই দিন সন্ধ্যায় ফল স্থগিত করার কথা জানায় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে শুরু থেকে ফল প্রকাশ পর্যন্ত গাফিলতি ও ‘একরোখা’ ভূমিকার পরিচয় দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষাবিদদের পরামর্শ উপেক্ষা করে গত বছরের শেষ সময়ে আকস্মিক ঘোষণা দিয়ে এ পরীক্ষা নেয়া হয়। যারা সরকারের শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল; তাদের কাজের দক্ষতা এবং সক্ষমতা নিয়ে এ ঘটনার পর জনমনে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একই দিন দুপুরে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সন্ধ্যায় স্থগিতের কারণে প্রশ্ন উঠেছে- কেন এবং কাদের কারণে শিশুদের এ পরীক্ষা নিয়ে এত বড় ভুলের ঘটনা ঘটল? জানা যাচ্ছে, ফল তৈরির সাথে যুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কারিগরি দলের ভুলে মূলত এ ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এ ‘দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের’ জন্য এখন যা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্রমতে, তিন বছর ধরে না হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলের মতো করে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল তৈরি করতে গিয়ে সমস্যাটি হয়েছে। ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হতো উপজেলাভিত্তিক। বৃত্তি পরীক্ষার ফল তৈরিতেও উপজেলাভিত্তিক ডাটা নিয়ে কাজ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রের কোডের ক্ষেত্রে ভুল হয়েছিল। এতে একাধিক উপজেলার কোড একই হওয়ায় সমস্যাটি হয়। দুই কোড যখন এক হয়ে যায়, তখন হয়তো যে শিক্ষার্থীর বৃত্তি পাওয়ার কথা নয়, সেও বৃত্তির তালিকাভুক্ত হয়েছে, আবার উল্টোটাও ঘটেছে। এমনকি নিবন্ধন করে পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও কেউ বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকাভুক্ত হয়। পরে আবার এই পরীক্ষার ফল সংশোধন করে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে প্রথম বার প্রকাশিত ফলের তালিকায় স্থান পাওয়া অনেকে বাদ পড়েছে। কারো নাম নতুন করে বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বটে। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্তই সার। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়; দেশে কোনো ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখে না। তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে পাওয়া দোষীদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নজির খুব কম। তদুপরি আগামীতে যাতে এ ধরনের সমস্যা এড়ানো যায় সে সম্পর্কে প্রণীত সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় না। তাই এ কথা বলা যায়, দেশের শিক্ষা বিভাগের বর্তমান এই বিশৃঙ্খল অবস্থা দূরের আশা আপাতত দুরাশাই থেকে যাবে।