
আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল-গম। এখনো এ দু’টি খাদ্যপণ্যের দাম খুব চড়া। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির তথ্য বলছে, দেশে চালের দাম কমছে না। গমের দাম বাড়ছে। চালের দাম বেশি থাকার প্রভাব খোলাবাজারে এবং এমএসের ট্রাকের দিকে তাকালে বোঝা যায়। ভোর থেকে সেখানে শত শত মানুষ কম দামে চাল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন। এর অর্থ বাজার থেকে চাল কেনার সামর্থ্য নেই এসব গরিব মানুষের। গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা স্টার্ট ফান্ডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের দরিদ্র অঞ্চলের মানুষের পারিবারিক আয়ের ৩৯ শতাংশ খাবার কেনায় ব্যয় হয়। আর ওই খাবারের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় চাল কিনতে। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব দরিদ্র মানুষ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দেয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ডব্লিউএফপির খাদ্য পরিস্থিতি-বিষয়ক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয়ার চিত্র উঠে এসেছে। বৈশ্বিক বাজারে এ দু’টি খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। চলতি মাসের শুরু থেকে বিশ্বের প্রধান চাল রফতানিকারক দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে চালের দাম কমেছে। আর রাশিয়া ও ইউক্রেনে চালের চেয়েও বেশি কমেছে গমের দাম। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএওর চলতি মার্চের বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের মূল্যবিষয়ক প্রতিবেদনেও দুই মাস ধরে চাল-গমের দাম কমার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশে দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই; বরং গত এক মাসে আটার দাম সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে। আর মোটা চালের দাম কমছে না। সরকার গত আমন মৌসুমে ৪২ টাকা কেজি দরে পাঁচ লাখ টন চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছিল। খাদ্য অধিদফতর ওই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল সংগ্রহ করেছে। চালকল মালিকরা এ দামে চাল সরবরাহ করেছেন। কিন্তু বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা কেজি দরে। সরকারকে কম দামে দিলেও চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা বাজারে বেশি দামে এ চাল বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, আমনের পর এবার বোরোর ফলনও ভালো হয়েছে। আমন এক কোটি ৭০ লাখ, বোরো দুই কোটি ১৫ লাখ টন ও আউশ ৩০ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার প্রায় পাঁচ লাখ টন বেশি বোরো উৎপাদিত হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, আমন মৌসুমে সরকার পাঁচ লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল সংগ্রহ হয়ে গেছে। সরকারি গুদামে এখন চাল ও গমের মজুদ ১৯ লাখ টনের বেশি। এ অবস্থায় দেশের বাজারে চালের সঙ্কট থাকার কথা নয়। দেশে উৎপাদন ভালো, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম পড়তির দিকে, তারপরও দেশে চালের দাম বাড়ছে কেন? চাল কীভাবে বাজারে ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, কারা বেশি দামে বিক্রি করছেন, বেশি মুনাফা করছেন, তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, একদল ব্যবসায়ী বছরের পর বছর কৃষকের কাছ থেকে কমে ধান কিনে ভোক্তাদের কাছে অনেক বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন। সরকারি সংস্থাগুলোর তদন্তেও তা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ সরকারের উচিত, যারা চালের দর বাড়ানোর কারসাজিতে জড়িত তাদের শনাক্ত করতে বিষয়টি খতিয়ে দেখা। কারসাজির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এটি না করার অর্থ হলো দেশের দরিদ্র মানুষের প্রতি এক ধরনের নিষ্ঠুর রসিকতা।