সমীকরণ ডেস্ক: ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটি। চারদিকে বরফ। ওদিকে তাক করে রাখা শত্রুশিবিরের বন্দুক। দুর্গম পরিবেশে পদে পদে ওত পেতে আছে হিমশীতল মৃত্যু। সেখানে জীবন-মৃত্যুকে বাজি রেখে ভারতের যেসব সীমান্ত জওয়ানরা দিনের পর দিন সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন, তারা দু’বেলা পেট ভরে খেতে পান না। সিনেমা নাটকে সেনার বীরত্বকে যেভাবে রোমান্টিক মোড়কে দেখানো হয়, বাস্তব কিন্তু মোটেই তা নয়। আসলে খাবার বলতে জওয়ানদের কপালে জোটে একখানা পোড়া পরোটা। তাতে নেই কোনো সবজি। দুপুরে যে ডাল দেয়া হয়, তা হলুদগোলা পানির চেয়ে বেশি কিছু নয়। কখনো খাবারের অভাবে খালি পেটেই দিন পার। কী করে সামনে এল এই রূঢ় বাস্তব? এমন তথ্য প্রকাশ্যে এনেছেন তেজ বাহাদুর যাদব নামে বিএসএফের এক সদস্য। ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, কীভাবে প্রতিটা দিন কাটে তাদের। সাধারণ মানুষের কাছে তার আবেদন, এই ভিডিও যেন ছড়িয়ে দেয়া হয় ভারতের সব এলাকায়। কত নিম্নমানের খাবার খেয়ে তারা জীবনধারণ করছেন, কী দুর্বিষহ কষ্টের মধ্যে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে, তা যেন জানতে পারেন ভারতের সব মানুষ। প্রশাসনের ওপর তার কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি জানেন, সরকার তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জন্য সব খরচই দেয়। কিন্তু ভূত আসলে সরষের ভেতরেই। সে কথা জানাতে দ্বিধা করেননি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওই জওয়ান। তার দাবি, ওপরওয়ালাদের হাতে হাতেই এই অর্থ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রয়োজনীয় ও সঠিক মানের খাবার পাচ্ছে না সাধারণ জওয়ানরা। এমনকি বিএসএফের ভেতরে কালোবাজারি এতটাই রমরমিয়ে চলছে যে, কোনো কোনো দিন খাবারের অভাবে খালি পেটেই শুয়ে পড়তে হয় তাদের। যাদবের আশঙ্কা, এই ভিডিও প্রকাশের পর তাকে হয়তো আর বাঁচিয়ে রাখা হবে না। কেননা ওপরওয়ালাদের প্রভাব অনেক বেশি। তবু জীবনহানির আশঙ্কা নিয়েও তিনি এ কাজ করেছেন। কারণ তিনি চান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে সাধারণ মানুষ সবাই জানুক, কী অবস্থায় দিন কাটে তাদের। দুর্নীতির কোন পোকা ফোঁপরা করে দিচ্ছে পুরো বাহিনীকে, সেটাই প্রকাশ্যে আনতে এতবড় ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, ফেসবুকে এই ভিডিও পোস্ট করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী অভ্যন্তরেই এই অভিযোগ জানাতে পারতেন তিনি। কিন্তু বাধ্য হয়েই এই পথ বেছে নিতে হয়েছে তাকে।
এদিকে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ামাত্রই তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে নেট দুনিয়ায়। যে সরকার সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কৃতিত্ব নেয়, তার আমলেই সীমান্ত রক্ষীদের এই হাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। ফলে নড়েচড়ে বসেছে বিএসএফ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তেজ বাহাদুরের ভিডিও দেখে এরই মধ্যে পুরো ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। পাশাপাশি, ‘নিরপেক্ষ তদন্তের’ স্বার্থে ওই বিএসএফ সদস্যকে ভারত-পাক সীমান্তের নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে সরিয়ে পুঞ্চে হেডকোয়ার্টার্সে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যাদবের অতীত রেকর্ডের কথা উল্লেখ করে তার ভিডিও পোস্ট করার উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। বিএসএফ কর্মকর্তারা জানান, আগেও তেজ বাহাদুর যাদব শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিলেন। এজন্য ২০১০ সালে তার কোর্ট মার্শালও হয়। কিন্তু পরিবারের কথা মাথায় রেখে তাকে তখন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়নি। জানা গেছে, সোমবার ভিডিওগুলো আপলোড করার পর তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। এ পর্যন্ত ৮০ লাখেরও বেশি বার ভিডিওগুলো দেখা হয়েছে। তেজ বাহাদুরের পোস্ট করা প্রথম ভিডিওতে দেখা যায়, বরফ পড়ছে এমন একটি পাহাড়কে পেছনে রেখে দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বিএএসফের দুর্দশার কথা তুলে ধরছেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আপনাদের এই ছবি দেখে হয়তো ভালো লাগছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা কেউ ভাবে না। কেউ দেখেও না। ঝড়-বৃষ্টি, বরফের মধ্যে আমাদের এক নাগাড়ে ১১ ঘণ্টা টানা দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিএসএফ জওয়ানরা কষ্ট করে দায়িত্ব পালন করলেও এর জন্য শারীরিকভাবে সক্ষম থাকার প্রয়োজনীয় খাবার পান না।’ তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের পাঠানো গম, চাল ও ডালসহ জিনিসপত্র গোডাউনে পৌঁছলেও এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা তা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। ‘বিএসএফ জওয়ানের নাস্তা’ শিরোনামের দ্বিতীয় ভিডিওতে তেজ বাহাদুর তাদের খেতে দেয়া রুটির মান তুলে ধরেন। তৃতীয় ভিডিওতে বিএসিএফ শিবিরে কিভাবে হলুদ ও লবণ দিয়ে ডাল তৈরি করা হয় তা দেখান তিনি। এ ব্যাপারে পরে টুইটারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, ‘বিএসএফ জওয়ানের পোস্ট করা ভিডিওটি দেখেছি। বাহিনীর কাছে দ্রুত প্রতিবেদন চাইতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি।’ স্বরাষ্ট্র সচিব কিরেন রিজ্জু টুইট করে বলেন, ‘বিএসএফ জওয়ানের ভিডিওটি গুরুত্বের সঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু সীমান্ত চৌকিগুলোতে আমার নিয়মিত পরিদর্শনকালে আমি জওয়ানদের মধ্যে বেশ সন্তুষ্টি দেখেছি।’ এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পর তেজবাহাদুরের ভিডিওটি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কথা জানিয়েছে বিএসএফ কর্তৃপক্ষ। এক টুইটে বিএসএফ বলেছে, জওয়ানদের সর্বোচ্চ কল্যাণের বিষয়ে বিএসএফ অত্যন্ত সংবেদনশীল। যদি কারও মধ্যে কোনো বিচ্যুতি ঘটে তা তদন্ত করে দেখা হয়। এরইমধ্যে একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।