সরিষাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
চুয়াডাঙ্গা সদরের মোমিনপুর ইউনিয়নের সরিষাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে একাধিক বিয়ে, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীদের তালাক দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এমনকি পরপর ৫টি বিয়ের পরেও গত দেড় মাস আগে ১০ম শ্রেণির এক ছাত্রীর সঙ্গে বাল্যবিবাহ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে টানা ৯ বছর সংসার করা চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার কুলচারার ওহিদের মেয়ে রহিমা খাতুন রুমিকেও তালাক দেন শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম। তালাকের পর শিক্ষক জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে যৌতুক ও পাশবিক নির্যাতনের দাবি তুলে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় একটি লিখিত অভিযোগ ও আদালতে মামলা করেন রহিমা খাতুন রুমি। লিখিত অভিযোগ ও মামলার পর থেকে ভুক্তভোগী রুমির পরিবারকে মামলা এবং অভিযোগ তুলে নিতে শিক্ষক জাহাঙ্গীর বিভিন্নভাবে হুমকিও দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হুমকি-ধামকি দেওয়ার কয়েকদিন পরে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রহিমা খাতুন রুমির পরিবার।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার হাজরাহাটি গ্রামের তীরপাড়ার সালেহার বিশ্বাসের ছেলে স্কুলশিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সরিষাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। এ পর্যন্ত তিনি ছয়টি বিবাহ করেছেন। বিয়ের পর তাঁর কাজ ছিল শুধু যৌতুক আদায় করা। যে স্ত্রী বা তাদের পরিবার যৌতুক দিতে অস্বীকার করত, ওই স্ত্রীকে পাশবিক অত্যাচার করে ডিভোর্স দিয়ে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসত সে।
চুয়াডাঙ্গা কুলচারা গ্রামের অহিদুল ইসলামের মেয়ে রহিমা খাতুন রুমি অভিযোগ করে বলেন, ‘২০১১ সালে পারিবারিকভাবে শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের এক মাস পর থেকে যৌতুক ও ধার বাবদ আমার বাবার কাছ থেকে পৃথকভাবে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে জাহাঙ্গীর। এরপরেও সে আবার টাকা চায়। না দিলে আমাকে পাশবিক নির্যাতন করতে থাকে। আমার বাবা আমার ওপর নির্যাতন হচ্ছে জানতে পারে এবং আমাদের ভিটা বাড়ি বিক্রি করে আবার যৌতুকের টাকা দেয় জাহাঙ্গীরকে। বিয়ের পর থেকেই জাহাঙ্গীর তার অসৎ চরিত্র গোপন করে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে টাকা আত্মসাত করার জন্য আমার নামে হাজরাহাটি গ্রামে ১০ কাঠা জমি ক্রয় করবে বলে আরও ৩ লাখ টাকা দাবি করতে থাকে। এ ছাড়াও তার পূর্বের বিয়েগুলো সে আমাদের কাছে গোপন করেছে। পরে বিষয়টি জানতে পারি। এরপর টাকা দিতে না পারাই আমাকে পাশবিকসহ নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৯ সালে আমাকে তালাক দিয়ে দেয়। অথচ ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে আমার পরিবার এখন নিঃস্ব। তাই আমার পরিবার চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় একটি লিখিত অভিযোগ ও কোর্টে একটি মামলা করেছে তাঁর বিরুদ্ধে। বর্তমানে সে মামলা চলমান রয়েছে। অথচ এই মামলা তুলে নিতে জাহাঙ্গীর আলম আমাদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। এ ছাড়াও সে মামলা চলাকালীন সময়ে দেড় মাস আগে দশম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে বাল্যবিবাহ করেছে বলে জেনেছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেকে জানান, ‘জাহাঙ্গীর আলম খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে তিনি সরিষাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। এ ছাড়া পরপর ছয়টি বিয়ে করেছেন তিনি। তাঁর কাজই ছিল স্ত্রীকে অত্যাচার করে যৌতুক আদায় করা। টাকা না পেলেই শুধু ডিভোর্স দিতেন স্ত্রীদের। বর্তমানে তিনি মাদকাসক্ত। মাস খানেক আগে আলমডাঙ্গা উপজেলার বটিয়াপাড়ার কবিরের মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী কিশোরী রুমা খাতুনকে বিয়েও করেছেন তিনি।’
বিয়ের পর তালাক দেওয়া তিনজন সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা শিক্ষক জাহাঙ্গীরের নির্যাতন ও যৌতুকের দাবি করার ঘটনা স্বীকার করে বলেন, ‘বিয়ের পর কয়েকমাস পর থেকে জাহাঙ্গীর যৌতুকের দাবি করত। কিছু টাকা দিলে দু-এক মাস চুপ থাকত। তারপর আবার টাকা চাইত, দিতে না পারলে পাশবিকসহ নানা নির্যাতনের শিকার হতাম আমরা। এরপর আমাদের তালাক দিয়ে দিয়েছে।’
এ বিষয়ে শিক্ষক জাহাঙ্গীরের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রহিমা খাতুন রুমিসহ পূর্বের স্ত্রীদের অত্যাচার করিনি এবং তাদের কাছে যৌতুকও দাবি করিনি।’ তবে দশম শ্রেণির ছাত্রীর সঙ্গে বাল্যবিবাহের বিষয়টি তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান এবং ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
সরিষাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষক জাহাঙ্গীর দেড় মাস আগে বিয়ে করেছেন বলে জানি। এর আগেও তিনি কয়েকটা বিয়ে করেছে বলে জানতাম। তবে কী কারণে তাঁদেরকে তালাক দিয়েছেন, সেটা জানি না।’
চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার শালিস বোর্ডের সভাপতি কাউন্সিলর মুন্সি রেজাউল করিম বলেন, ‘রহিমা খাতুন রুমির পিতা চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র বরাবর একটি অভিযোগ দিলে তা তদন্ত করা হয়। বাদী ও বিবাদীদ্বয়ের উপস্থাপিত রেকর্ডপত্র এবং বাদী ও বিবাদী পক্ষের সাক্ষীর বক্তব্য পর্যালোচনা করে শালিস বোর্ড জানতে পারে বাদী অহিদুল ইসলামের অভিযোগ সত্য। তিনি নিজের বসত ভিটা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। যার সমুদয় অর্থ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করে তাঁর জামাই স্কুলশিক্ষক জাহাঙ্গীরকে প্রদান করেছেন বলে আমাদের তদন্তে উঠে আসে। তাই বাদী কর্তৃক আনীত সব অভিযোগ সত্য। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি এই তদন্ত প্রতিবেদনের রিপোর্ট অনুয়ায়ী বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পৌর মেয়র ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু প্রতিবেদনটি প্রেরণ করেন।’
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জিহাদ বলেন, ‘এ বিষয়ে কোর্টে একটি মামলা চলমান। মামলার পর থেকেই বাদী পক্ষকে হুমকি-ধামকি দেওয়ার অভিযোগে সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন রহিমা খাতুন রুমি। ঘটনাটি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিবাহের বিষয়টি নিজের একান্ত বিষয়। তবে চারটি বিয়ে, প্রতিটি বিয়ের পর আবারো যদি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিবাহে অবদ্ধ হয়ে থাকেন, তাহল এটা আসলেই ঘৃণ্য কাজ। যেহেতু নির্যাতন ও যৌতুকের এই বিষয় নিয়ে আদালতে মামলা চলছে, তাই আমি কোনো মন্তব্য করব না। আদালতের নির্দেশ পেলে বিভাগীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’