পরিবেশদূষণের বিরূপ প্রভাব দেশে; ভবিষ্যৎ প্রজন্মও পড়বে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে

সম্পাদকীয়

দেশে নানাভাবে পরিবেশদূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বায়ুদূষণ। এতে প্রাণ-প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব পড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো- পরিবেশদূষণে কম ওজনের শিশু জন্মাচ্ছে, মানুষ ভুগছে স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক ও ডায়াবেটিসে। অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় কয়েকটি শহরের পরিবেশদূষণের জন্য মূলত দায়ী সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডস, ওজোন, কার্বন-মনোক্সাইড ও পার্টিকুলেট ম্যাটার। এ গ্যাসীয় পদার্থগুলো তৈরি হচ্ছে যানবাহন, কলকারখানা, ইটের ভাটা থেকে। সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধীন ‘অ্যামবিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক রিপোর্টে স্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আটটি সিটি করপোরেশনের বায়ুতে সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডস, ওজোন, কার্বন-মনোক্সাইড ও পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ অত্যাধিক বেশি রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। লক্ষণীয়, সারা দেশে সাম্প্রতিক কালে বায়ুদূষণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে। বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় গতকাল শনিবার সকালেও ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সকাল সাড়ে ৯টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ২৮৮ নিয়ে রাজধানীর বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ছিল। অথচ ১০১ থেকে ২০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোরই সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোর ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১ থেকে ৪০০ এর এর মধ্যে থাকা একিউআই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। যেসব উপাদান বায়ুতে মিশেল দূষণ ঘটাচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো পার্টিকুলেট ম্যাটার। ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চলে পার্টিকুলেট ম্যাটারের কারণে মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পার্টিকুলেট ম্যাটার এত ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম যে এগুলো সরাসরি মানুষের ফুসফুস, হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে যাচ্ছে এবং ব্রেইন স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের কারণ হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- সম্প্রতি একটি গবেষণার পর চিকিৎসকরা বলছেন, পরিবেশদূষণে শিশুরা কম ওজন নিয়ে জন্মাচ্ছে এবং সময়ের আগে (৩৭ সপ্তাহ) জন্মাচ্ছে। আর সালফার-ডাই-অক্সাইডে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি ঘনত্বের সালফার-ডাই-অক্সাইডে কয়েক মিনিট অবস্থান করলে শ্বাসবন্ধ এবং মৃত্যুঝুঁকিসহ পালমোনারি সমস্যা হতে পারে। গ্যাসীয় পদার্থটি শুধু যে মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে তা নয়, গাছের বৃদ্ধি কমায়, পাতার ক্ষতি করে এবং সর্বোপরি বৃক্ষের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। একই সাথে শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের হাঁপানি রয়েছে তারা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। নাইট্রোজেন অক্সাইডও আমাদের শহরাঞ্চলে পরিবেশদূষণের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। এর আরেকটি ফর্ম নাইট্রাস অক্সাইড গ্রিনহাউজ গ্যাস তৈরিতে ভূমিকা রাখে। গ্রিনহাউজ গ্যাস পরিবেশে তাপ আটকে রাখে। জ্বালানি তেল পোড়ানো হয় এমন যানবাহন থেকে নাইট্রোজেনে অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। এ ছাড়া কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ইঞ্জিন থেকে গ্যাসটি নির্গত হয়। গ্যাসটির ঘনত্বের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকলে শরীরে জ্বালাপোড়া, গলার কোষ ফুলে যাওয়া, শ্বাসতন্ত্রের উপরের অংশে সমস্যা, গলায় খিঁচুনি, ফুসফুসে জলীয় দ্রবণ তৈরি করে। এটি রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছাতে বাধার সৃষ্টি করে। এ ছাড়া অবসন্নতা, বিষণ্নতা, ঠোঁট ও শরীরের বিভিন্ন অংশ নীল হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। রূঢ় বাস্তবতা হলো- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়নের নামে দেশের শহরগুলোর পরিবেশ ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। তার নমুনা হিসেবে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে কম ওজনের অনেক শিশুর জন্ম নেয়া। এতে প্রমাণিত হয়, দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্য দিন দিন অবনতির দিকে। তবে এ নিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাই এ কথা বলা যায়, যদি পরিবেশদূষণ কমানো না যায়; তা হলে বর্তমান প্রজন্মই শুধু নয়, আগামী প্রজন্মও ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।