কঠোর পরিশ্রমী যুবক, একটি স্বপ্ন অতঃপর নির্মম মৃত্যু
প্রতিবেদক, কালীগঞ্জ:
সৎ ও সদালাপী পিকুল হোসেন এলাকার এক সময়কার দাপুটে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। যুবক বয়স হতেই এ পেশায় তাঁর হাতে খড়ি। ইলেকট্রিকের কাজ করেই বাবার সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বাবার ভিটের দালান ঘরে জায়গা হয়নি তাঁর। তাঁকে রাখা হয় টিনের ছাউনি ও টিন দিয়ে ঘেরা পরিত্যাক্ত একটি চালা ঘরে। যেখানে আগে গরু রাখা হতো। এখানে মৃত্যু পথযাত্রী ও শয্যাশায়ী থেকে গত শুক্রবার মারা গেলেন তিনি। অথচ জীবন সাহাহ্নে এসে পিকুলের আশা ছিল বাবার দালান ঘরে ওঠার। কিন্তু চরম অসুস্থতার মধ্যেও পারিবারিক চাপে জায়গা হয়নি। মৃত্যুর পর বিকেলে তাঁর মরদেহ তোলা হলো বাবার দালান ঘরের বারান্দায়। নিহত পিকুল হোসেন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের হাট বেলাট গ্রামের ইউনুছ আলী শেখের ছেলে। বাবা অকালে চলে যাওয়ায় অবুঝ তিনটি শিশুর কান্নায় এলাকার বাতাস ভারি হয়েছে। মৃত্যুর আগে পিকুল হোসেনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, প্রায় ৫-৬ শতক জমির ওপর প্রাচীরে ঘেরা চার কক্ষের বেশ পরিপাটি একটি দালান বাড়ি। এছাড়াও বাড়ির মধ্যে রয়েছে আরও একটি টিনের চালা ঘর। সেখানে শুয়েছিলেন দূরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী পিকুল হোসেন। পাশে বসে চোখের পানি ফেলছিলেন স্ত্রী আসমা খাতুন আর তাঁর শিশু সন্তানেরা।
পিকুলের স্ত্রী আসমা খাতুন জানান, ‘আজ থেকে সাত বছর আগে পিকুলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তিন ভাইয়ের যৌথ পরিবার ছিল। সে সময়ে ওই দালান ঘরে আমার স্বামীরও একটি কক্ষ ছিল। বিয়ের পর কয়েক বছর এখানে বসবাস করেছি। পৃথক হওয়ার কিছুদিন পর পিকুলের বড় ভাই গ্রামের অন্যস্থানে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেছে। ফলে শ্বশুরবাড়ির ঘর খালি হয়ে যায়। অথচ পরিবারে দ্বন্দ্বের কারণে আমাদেরও ভাড়া বাসায় উঠতে হয়। বাবার ভিটে, তাই আমার স্বামীরও অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমাদের উঠতে দেওয়া হয়নি। তারপরও স্বামীর সৎ পথের রোজগারে এক কন্যা ও জমজ দুই শিশুপুত্র নিয়ে ভালো ছিলাম। কিন্তু আমার স্বামীর ক্যানসার ধরা পড়লে চিকিৎসার জন্য সবকিছু ব্যয় করেছি। সর্বশান্ত হয়ে উঠেছিলাম স্বামীর বড় ভাইয়ের বাড়িতে। সেখানে বেশ কিছুদিন থাকার পর গ্রামবাসীর সহযোগিতায় বাড়িতে আনা হয়। কিন্তু জায়গা হয়নি বাবার ভিটের দালান ঘরে। সে সময়ে অমানবিকভাবে ঠাই দেওয়া হয়েছে বাড়ির ভেতরের টিনের একটি চালার মধ্যে। যেখানে আগে গরু রাখা হতো। টিনের এমন বদ্ধ ঘরের গরমে অসুস্থ পিকুল আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু আজ সবশেষ হয়ে গেল।’ এখন অবুঝ তিনটি শিশুকে নিয়ে কী করবেন বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
প্রতিবেশী আরশেদ আলী ও আবুল হোসেন জানান, পিকুলের মাঠে কোন চাষযোগ্য জমি নেই। তিনি বারোবাজার এলাকায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। সারা জীবন খুব পরিশ্রমের মাধ্যমে সৎপথে রোজগার করেছেন। বেশ কিছুদিন ধরে দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। অর্থের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাসেবাও নিতে পারেননি। এক সময় তিনি বাবার বাড়ির দালান ঘরের একটি কক্ষে থেকে সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু পারিবারিক সমস্যায় ঝামেলা এড়াতে পিকুলকে ভিটে ছাড়তে হয়েছিল। পরে শয্যাশায়ী হওয়ার পর এলাকার মানুষের সহযোগিতায় বাবার ভিটেই উঠিয়েছিলেন। কিন্তু কষ্টের বিষয় ঘর ফাঁকা পড়ে থাকলেও শয্যাশায়ী এ মানুষটির বাবার ঘরে জায়গা দেওয়া হয়নি। পরিবারের লোকজন তাঁকে রেখেছিলেন পরিত্যাক্ত এক সময়ের গরু রাখার গোয়াল ঘরে। সেখানেই থেকেই শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর পরে তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণে বাবার ঘরের বারান্দায় মরদেহ রাখা হয়েছিল। এখান থেকে নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যায় দাফন কাফন করানো হয়। তাঁরা বলেন, একজন অসুস্থ মানুষকে বদ্ধ একটি টিনের চালার মধ্যে রাখাটা ছিল খুবই নির্মমতা ও অমানবিক।
ওই গ্রামের রেকসোনা নামের এক গৃহবধূ জানান, বাবার বাড়িতে অসুস্থ থাকা অবস্থায় প্রথম দিকে পিকুল ও তাঁর স্ত্রী শিশু সন্তানেরাও চরম খাওয়ার কষ্ট করেছে। পরে মহল্লাবাসী গরিব হলেও যে যেমন পেরেছে, তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু আজ জীবন প্রদীপ নিভে গেল পিকুলের। এখন এই অবুঝ শিশুদের দেখবে কে?
বয়োবৃদ্ধ পিতা ইউনুছ আলী শেখ জানান, ‘আমার তিন ছেলের মধ্যে পিকুল মেজো। বড় ছেলে একটু দূরে আলাদা বাড়ি করে বসবাস করছে। আমি ছোট ছেলের সঙ্গে থাকি। ভুল বোঝাবুঝির কারণে মেজো ছেলে পিকুল বাড়ি ছেড়েছিল। শয্যাশায়ী হয়ে সে আবার বাড়ি ফিরেছিল। বয়সের ভারে আমি নিজেও ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না। অসুস্থ পিকুলকে দেখতে মানুষ প্রতিদিন ভিড় করত, তাই তাকে বাইরের একটি ফাকা ঘরে রাখা হয়েছিল। যে ঘরটিতে আগে গরু রাখা হলেও এখন এটা বসবাসের উপযোগী।’
ওই এলাকার বাসিন্দা বারোবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাবুবুর রহমান রনজু জানান, পারিবারিক সমস্যার কারণে আব্দুল ওয়াহেদ নামের তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করতেন পিকুল। পরে ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়লে পিকুলকে বাড়িতে তোলা হয়। তবে বাবার সঙ্গে পিকুলের ভালো বনাবনি ছিল না বলে এমনটি হয়েছে বলে লোকমুখে শুনেছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ঠ ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য তরিকুল ইসলাম বুদু জানান, পিকুল পরিশ্রমী একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর এলাকায় যত ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আছেন, সবাই তাঁর শিষ্য। এক সময়ে তাঁর রোজগারের টাকায় বাবার সংসার চলেছে। অথচ অসুস্থ হলে তাঁকে রাখা হয়েছিল এক সময়কার পরিত্যাক্ত গোয়াল ঘরে। সেখানে থেকেই শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যেটা ছিল অমানবিক। শুক্রবার সন্ধ্যার পর তাঁর দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, পিকুলের শেষ ইচ্ছা ছিল বাবার দালান ঘরে উঠে তাঁর মৃত্যু যেন হয়। তার সেই ইচ্ছা পূরণ ঠিকই হয়েছে, তবে মৃত্যুর পরে। তিনি আরও বলেন, পিকুলের মৃত্যুর পর অবুঝ তিনটি শিশুর কান্নায় এলাকার সব মানুষকে কাঁদিয়েছে। এখন তার পরিবারসহ এলাকার লোকজন তাঁর স্ত্রীসহ অবুঝ তিনটি শিশুর কথা ভাবছেন।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার জানান, পিকুলের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। অসুস্থ পিকুলকে পরিবারের পক্ষ থেকে পরিত্যক্ত একটি গোয়াল ঘরে রাখা হয়েছিল, সেখানে গেলে এলাকার লোকজন তাঁকে জানান। এটা অবশ্যই নির্মমতা। তিনি বলেন, পিকুলের স্ত্রী ও অবুঝ তিনটি শিশুর ব্যাপারে সবাইকে সহায় হওয়ার জন্য বলে এসেছেন।