নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি!

চুয়াডাঙ্গায় বিএসটিআই-এর অনুমোদন ছাড়াও চলছে একাধিক কারখানায় পণ্য উৎপাদন
মেহেরাব্বিন সানভী:
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের অধিকাংশ বেকারি কারখানায় নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, টোস, চানাচুরসহ বিভিন্ন ধরনের বেকারি খাদ্যদ্রব্য। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কারিগররা হাতে পরছেন না গ্লাভস, মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপসহ নির্দিষ্ট পোশাক। অস্বাস্থ্যকর নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে তৈরি এসব খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কারখানার মালিকেরা। বিএসটিআই তো দূরের কথা, সিভিল সার্জন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের প্রয়োজনীয় কাগজপাতি পর্যন্ত নেই অনেক প্রতিষ্ঠানের। আবার কেশকিছু প্রতিষ্ঠানের একটি খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের বিএসটিআই অনুমোদন আছে, কিন্তু তারা উৎপাদন করছে একাধিক খাদ্যদ্রব্য। ফলে এ ধরণের বেকারিতে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছেন জেলাবাসী। প্রশাসনের হস্তক্ষেপের বিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ থাকলেও চুয়াডাঙ্গা ভোক্তা অধিকার বলছে, তাদের অভিযান অব্যহত আছে। ছাড় দেবে না এসব অস্বাস্থ্যকর নোংরা প্রতিষ্ঠানকে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অচিরেই প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযোগের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে কয়েকটি বাদে বেশ কিছু কারখানার নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানসহ শহরের নামি-দামি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারখানায় মানা হচ্ছে না খাদ্যদ্রব্য তৈরির আইন। করোনাভাইরাসের সময়কালেও প্রতিষ্ঠানের কারিগররা হাতে পরছেন না গ্লাভস, মাথা ও মুখে নেই মাস্কসহ নির্দিষ্ট পোশাক। ফলে খালি হাতে খাদ্যদ্রব্য তৈরি করার সময় কারখানার ভেতরে প্রচণ্ড গরমে কারিগরদের গায়ের ঘাম মিশে যাচ্ছে এসব খাবারে। ফলে এ খাবারই এক প্রকার বাধ্য হয়ে প্রতিনিয়ত খেতে হচ্ছে এ জেলার মানুষের। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বাদুরতলা এলাকায় রাস্তার বিপরীতে ওয়াপদা রোডে গ্রীন ফুডের একটি কারখানা, দৌলাতদিয়াড় বিএডিসি এলাকায় রাস্তার বিপরীতে সাম্পানের কারখানা, ঠিক তার সামনেই আকরামের মিনার মার্কা সেমাই। এসব কারখানায় নোংরা, ধুলা-বালি ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে খোলা অবস্থায় রাখা হয়েছে প্রস্তুতকৃত খাদ্যদ্রব্য। যার ওপর জীবাণু বহনকারী মাছির রয়েছে অবাধ বিচরণ।
মিনার মার্কা সেমাই তৈরির মিলে গিয়ে দেখা যায়, ময়দা মাখানোর মেশিনগুলো দেখলে মনে হয় কয়েকমাস পরিস্কার করা হয়নি। ভুলক্রমে ময়দার মিশ্রন নোংরা মেঝেতে পড়ে গেলেও সেটাও তুলে ব্যবহার করা হচ্ছে। শ্রমিকেরা দল বেধে এক সঙ্গে খাবারও খাচ্ছেন প্রস্তুতকৃত সেমাইয়ের পাশে। সেখানেই ফেলছেন নোংরা। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে শ্রমিকদের সরল জবাব, এখনি ঝাড়ু দিবেন। ঝাড়ু দেওয়ার সময় বাতাসে ওড়া ময়লা খবারে পড়বে, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই তাঁদের কাছে। কোনো শ্রমিকের মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ড গ্লাভস নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফ্যাক্টরির মালিক আকরাম বলেন, সবকিছুই দেওয়া হয়েছে তবে শ্রমিকেরা ব্যবহার করছেন না। কেন করছেন না এ প্রসঙ্গে বলেন, গরমে পরে থাকা নাকি সম্ভব হয় না। তবে তাঁর এ উত্তর সাধারণ ভোক্তার কাছে বা ভোক্তা অধিকার আইনে যথাপোযুক্ত নয়। তবে বিএসটিআই খুলনা কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বিএসটিআই অনুমোদন নেই।
এদিকে, দৌলাতদিয়াড় দক্ষিণপাড়ার জাহাঙ্গীরের চানাচুর ফ্যাক্টরি ও একই এলাকার সর্দারপাড়ার মিণ্টুর চানাচুর ফ্যাক্টরিতে গেলে পরিবেশের অবস্থা ভালো পাওয়া যায়নি। জাহাঙ্গীরের চানাচুরের ফ্যাক্টরিতে চানাচুর তৈরি দেখা না গেলেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে মিশ্রি। যা একটি টিনের ঘরে খোলা স্থানে জমতে দেওয়া হয়েছে। আবার তৈরির সময় অতিরিক্ত মাত্রায় মিশ্রি সাদা করা রাসায়নিক মেশাতে দেখা গেছে। সেখানে থাকা শ্রমিকেরা অনুমোদনের বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাঁদের দেওয়া জাহাঙ্গীরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তবে মিশ্রি সবাই একইভাবেই জমায়। আমার সকল অনুমোদন আছে।’
অপর দিকে বিএডিসি এলাকায় নাজমা চানাচুরের ফ্যাক্টরিতে গেলে দেখা যায়, খালি গায়ে খালি পায়ে স্যাঁতস্যাঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করছে কিশোর বয়সী শ্রমিকসহ অনেকেই। মুখে মাস্ক নেই, তবে এক জায়গায় ৮ থেকে ১০ জন দাঁড়িয়ে প্যাকেট করছেন চানাচুরের। ময়দা মিক্সকারীর হাতেও দেখা যায়নি মাস্ক। মেশিনটির দিকে তাকালে মনে হয় বহুদিন ধরে পরিস্কার করা হয়নি। এ বিষয়ে নাজমা চানাচুরের দায়িত্বে থাকা সোহেল মুঠোফোনে জানান, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরির চেষ্টা তাঁরা করছেন। বর্ষাকালে একটু স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ থাকবেই।
এদিকে চুয়াডাঙ্গার লাভলি চানাচুরের ফ্যাক্টরিতে গেলে দেখা যায়, পরিবেশগত দিক থেকে মোটামুটি ভালো। কিন্তু চানাচুর তৈরির ময়দা যিনি হাতে কাটছিলেন, তাঁর মুখে মাস্ক ছিল না। আর সবাই ঘেমে একাকার। এতে করে ঘামমিশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে প্যাকেটিং করার সময় সবার মুখেই মাস্ক পাওয়া গেছে।
ডিঙ্গেদহ বাজারের কাশেম এন্ড সন্সের কারখানার পরিবেশ সবথেকে খারাপ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই সবকিছু উৎপাদন। আবার একই স্থানে খাওয়া-দাওয়া করছেন কর্মচারীরা। ভেতরেই টিউবওয়েল। যেখানে গোসলও করছেন তাঁরা। আর টিউয়ওয়েল পাড়ের অবস্থা দেখলে খাওয়ার রুচি যেকোনো সাধারণ রুচিশীল মানুষেরই নষ্ট হওয়ার কথা। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কাজী আবুল কাশেমের সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে কথা হয় তাঁর পুত্র কাজী আমিরুলের সঙ্গে। খারাপ পরিবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর থেকে ভালো পরিবেশ করা সম্ভব না।’ কাগজপাতির বিষয়ে বলেন, ‘আমার পিতা মুক্তিযোদ্ধা। ওসব আমার লাগে না।’ ট্যাক্সের বিষয়েও তাঁর একই বক্তব্য।
অন্যদিকে, তালতলার নিউ ভ্যানিলা ফুডের কারখানায় গেলে পরিবেশ অনেকটাই ভালো পাওয়া গেছে। কারখানটি সিসিটিভির ক্যামেরায় আওতায় থাকাসহ পরিবেশগত দিকেও বেশ ভালো। কারিগরদের মুখে মাস্ক এবং হাতে হ্যান্ড গ্লাভস ছিল। মালিক দ্বীন মোহাম্মদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের জন্য হাতের গ্লাভস, মাথা ও মুখের মাস্কসহ নির্দিষ্ট পোশাক আছে। আমি চেষ্টা করি পরিবেশগত দিক দিয়েও যেন ভালো থাকে।’
এদিকে, চুয়াডাঙ্গা সদরের সাতদাড়ির মেসার্স চুয়াডাঙ্গা ভ্যানিলা ফুড প্রোডাক্টসকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য তৈরির অপরাধে গত ২৩ আগস্ট চুয়াডাঙ্গা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। তাদের বিএসটিআই অনুমোদন আছে শুধুমাত্র বিস্কুটের। কিন্তু তারা কেক এবং পাউরুটিও উৎপাদন করে। অন্যদিকে, আন্দুলবাড়িয়ার মেসার্স শাপলা ফুডস, জগন্নাথপুরের মেসার্স সাইদুর বেকারিকে কয়েকদিনের ব্যবধানে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গা। খুলনা বিএসটিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী তাদের কারোর বিএসটিআই অনুমোদন নেই। এ রকম আরও বহু প্রতিষ্ঠান লুকিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন করছে খাদ্যদ্রব্য।
চুয়াডাঙ্গা রেল গেটের পাশে অনন্যা ফুডের ফ্যাক্টরির পরিবেশ মোটামুটি ভালো দেখা গেছে। তবে বাদুরতলা এলাকায় রাস্তার বিপরীতে ওয়াপদা রোডে গ্রীন ফুডের কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে পরিবেশটি স্যাঁতস্যাঁতে। কয়েকজন কারিগর মাস্ক পরলেও বেশিরভাগ কারিগররা হাতের গ্লাভস, মাথা ও মুখের মাস্কসহ নির্দিষ্ট পোশাক পরেননি। এ বিষয়ে গ্রীন ফুডের মালিক ও জেলা বেকারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ঘোরী হাসান জোয়ার্দ্দারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য। আসলে শ্রমিকেরা বেশিরভাগই অশিক্ষিত। তাঁদেরকে বার বার বলেও ঠিক করা যায় না। তবুও আমি প্রতিদিনই বলি।’ তাঁর কাছে বেকারি মালিক সমিতির পক্ষে পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সতর্ক করি এবং সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বেকারি পরিচালনা করতে বলি।’
সচেতন মহলের দাবি, প্রশাসনের নজরদারি কম থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন এ ধরনের নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করতে সাহস পাচ্ছে। প্রশাসন একটু কঠোর হলে প্রতিষ্ঠানগুলো আইনের বাইরে যেতে পারবে না।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি অ্যাড. মানিক আকবরের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে তাঁরা একত্রে কাজ করছেন। এসব নোংরা ও খারাপ পরিবেশে খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী কোনো প্রতিষ্ঠান যেনো ছাড় না পায়, সে বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা ভোক্তা অধিকার ও স্থানীয় প্রশাসন খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার সহকারী পরিচালক সজল আহমেদ বলেন, স্থানীয় প্রশাসনসহ তাঁদের অভিযান অব্যহত আছে। ছাড় দেবেন না এসব অস্বাস্থ্যকর নোংরা প্রতিষ্ঠানকে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বার বার তাদের জরিমানা ও সতর্ক করছি। কিন্তু সচেতনতার অভাব এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের। তবে অতিদ্রুতই আরও কঠোর অবস্থানে যাবে।’
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, বেকারিগুলোকে বারবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতন করা হয়। করোনাভাইরাসের এই সময়ে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন মেনে নেওয়া যাবে না। আর বিএসটিআই বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন না থাকলে কোনো বেকারি প্রতিষ্ঠান চলেবে না। অচিরেই প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।