নিরাপদ সাইবার ব্যবস্থা নেই; ক্ষতির শিকার জাতি

পৃথিবীর মানুষের কর্মকাণ্ডকে এখন দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা বাস্তব দুনিয়ায় শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে, অন্যটি সাইবার দুনিয়ায় উপস্থিত না হয়েও যা করা যায়। ধীরে ধীরে মানুষ অনেকটাই সাইবার জগতের ওপর নির্ভারশীল হয়ে উঠছে। প্রথমে এর দ্বারা চিঠিপত্রের মতো যোগাযোগ মানুষ সারতে থাকে, আর বিনোদন নিতে এর ব্যবহার করেছে, পরে আর্থিক লেনদেন যুক্ত হয়েছে, এখন কেনাবেচাসহ প্রায় সব কাজই ডিজিটাল মাধ্যমে হচ্ছে। এতে একদিকে মানুষের কাজ সহজ হচ্ছে; অন্যদিকে জালিয়াতি প্রতারণাও বাড়ছে। সামাজিকমাধ্যমে এক ধরনের লাঞ্ছনা যাকে বুলিং বলা হচ্ছে, ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। আরেকটি শ্রেণি তৈরি হচ্ছে যারা এর প্রতি আসক্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

প্রযুক্তির দুইটি দিক থাকে। তবে ইতিবাচক দিকের চেয়ে ক্ষতিকর দিকটি প্রধান হয়ে উঠলে তা সর্বনাশের কারণ হয়। একদিকে সাইবার হামলা, অন্যদিকে এক শ্রেণির মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি ডিজিটাল কার্যক্রমকে বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে ‘বিজিডি ই-গভর্নমেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম’ সংক্ষেপে সার্ট। তারা জানাচ্ছে, গত বছর বিভিন্ন ডাটাবেজে সাইবার দুর্বৃত্তরা তিন হাজার ৮৩৮টি সংবেদনশীল তথ্য চুরি করেছে। হ্যাকিং করে তারা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা সংস্থার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগার থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটিও একই ধরনের একটি অপরাধ।

২০১৬ সালে হ্যাকাররা ৩৫টি প্রতারণামূলক নির্দেশ দিয়েছিল। সবগুলো সফল হলে এক বিলিয়ন ডলার বেহাত হয়ে যেত। সার্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা চুরি করে তুরস্কের একটি ব্যাংকে নেয়া হয়। ২০১৯ সালে তিনটি ব্যাংকের ক্যাশ মেশিন থেকে ক্লোন করে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ৩০ লাখ টাকা হ্যাক করা হয়। এছাড়া ই-কমার্সের নামে ব্যাপক আকারে প্রতারণার শিকার হয়েছে বিরাট একটি জনগোষ্ঠী। এখনো বাংলাদেশের সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাইবার হামলার বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

আরেকটি ভয়াবহ ক্ষতির দিক হচ্ছে, অতিমাত্রায় ডিজিটাল আসক্তি। বিশেষজ্ঞরা এর নাম ‘স্ক্রিন টাইম’ দিয়েছে। একটি শ্রেণি রাত দিন বিশেষত মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি, বার্তা আদান প্রদান, অপপ্রচার চালানো, বুলিং করে এবং পর্নোগ্রাফিতে নিমজ্জিত হয়। জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ মাদকের নেশার মতো এতে আসক্ত হয়ে গেছে। এতে তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার চেয়ে ভয়াবহ আকারে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন মানসিক রোগে। এই রোগ শেষ পর্যন্ত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটাচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরো ভয়াবহ। অনেক সময় পিতা-মাতা তাদের ব্যস্ত রাখতে মোবাইল হাতে ধরিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত সেটা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়। কিশোরেরাও এর কুফলের শিকার। সাইবার দুনিয়ায় নারীরা ব্যাপক বুলিংয়ের শিকার হয়। তাদের লক্ষ করে যৌন হেনস্তা করা হয়। অধিকাংশ নারী কোনো কোনোভাবে এর দ্বারা আক্রান্ত হন।

ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কল্যাণে নিযুক্ত হতে হলে সচেতনতা দরকার। সেজন্য দরকার ব্যাপক প্রস্তুতি। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কোনো পর্যায়ে সেটা নেই। ফলে এ থেকে আমরা যতটা উপকৃত হচ্ছি, ক্ষতির শিকার হচ্ছি তার চেয়ে বেশি। জাতীয় জীবনে সাইবার প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহারে বিশ্বের সবচেয়ে পেছনে থাকা জাতির মধ্যে আমরা রয়েছি। শিশু কিশোররা কিভাবে এর ব্যবহার করবে সে ব্যাপারে কোনো ধরনের সতর্কতা নেই। জাতীয় পর্যায় থেকে এ নিয়ে কোনো ধরনের নীতি নেওয়া হয়নি। স্কুল পড়-য়ারা এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে ধ্বংসের মুখে পড়ছে। যেসব অভিভাবক সচেতন নন তাদের কম বয়সী সন্তানরা এ থেকে ভয়াবহ ক্ষতির মুখেই পড়ছে।

আমরা মনে করি, জাতীয় একটি সাইবার নীতি থাকা উচিত। এর আওতায় একটি ব্যাপক প্রচারণা থাকা দরকার। প্রথমত মানুষকে এ কেন্দ্রিক জালিয়াতি থেকে রক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সবধরনের প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। অন্যদিকে শিশু কিশোরদের এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের নীতি নিতে হবে। সেটা কিভাবে জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োগ করা হবে তারও একটি গাইডলাইন থাকতে হবে।