
সমীকরণ প্রতিবেদন:
মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ব্যাংক বন্ধ হওয়ার ঘটনায় দেশের ব্যাংক খাত নিয়েও নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। যদিও এখন পর্যন্ত মার্কিন ওই ব্যাংক দুটির সঙ্গে দেশের কোনো ব্যাংকের লেনদেনের খবর সামনে আসেনি। তারপরও এ ঘটনাকে দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য অগ্রিম সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনা থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, ব্যাংক পরিচালনায় মালিকদের হস্তক্ষেপ ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতের ওপরও গ্রাহকের আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশের ব্যাংক খাতের ঋণমানকে স্থিতিশীল থেকে নামিয়ে নেতিবাচক রেটিং দিয়েছে মুডি’স। এসব কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই কালক্ষেপণ না করে এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। নজরদারি ও তদারকি বাড়াতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কারণে ব্যাংক বন্ধ হয়েছে, সেসব কারণ বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে ঝুঁকি নেই।
মূলধন সংকট ও তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে গত শুক্রবার বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)। এরপর রবিবার নিউইয়র্কভিত্তিক সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ক্যালিফোর্নীয় ডিপার্টমেন্ট ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন। ব্যাংক দুটি বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, স্টার্টআপ খাতে ছোট উদ্যোগে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ, গৃহায়ণ খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভাষ্য অনুযায়ী, এই দুটি ব্যাংক বন্ধ করা না হলে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ত।
বর্তমানে দেশে ৬১টি ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা ৫২টি। এ তালিকায় আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি, বিশেষায়িত ৩টি ও বেসরকারি ৪৩টি ব্যাংক। এর পাশাপাশি দেশে নয়টি বিদেশি ব্যাংকও কার্যক্রম চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ব্যাংক খাতে রয়েছে নানা সংকট ও ঘাটতি। এর মধ্যে অন্যতম হলো- সুশাসনের ঘাটতি, ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালকদের মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়া ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতিতে বড় ধরনের ফাঁকি। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু সংকট যতই হোক, ইমেজ রক্ষার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যাংকই বন্ধ হতে দেয় না। নীতি সহায়তা দিয়ে সচল রাখে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, সামান্য তারল্য সংকট ও শেয়ারের দরপতনের কারণে ওই দেশে দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এ অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সব ব্যাংকই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাংক বাঁচিয়ে রেখে উল্টো মালিকদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংক পরিচালনায় মালিকদের হস্তক্ষেপ, সুশাসনের ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও ঋণ কেন্দ্রীভূত প্রভৃতি বিষয় দেশের ব্যাংক খাতের জন্য বড় ঝুঁকি। এসব ঝুঁকি কে বহন করতেছে। আল্টিমেটলি এই ঝুঁকিগুলো বহন করতেছে সরকার বা দেশের সাধারণ মানুষ। এই ঝুঁকিগুলো বহন করেই ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন সাধারণ জনগণ এই ঝুঁকিগুলো বহন করবে। বরং যারা প্রতিযোগিতায় টিকবে না, তাদের থাকার দরকারই বা কেন। এ কারণেই এক্সিট পলিসি দরকার, যা আমাদের নেই। বিভিন্ন সময়ে আমি এটা করার কথা বলে আসছি। এক্সিট পলিসি করে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যাংকের স্ট্যাবিলিটি বাড়ানো সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. নূরুল আমিন আমাদের সময়কে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ওই ব্যাংক দুটো আমাদের দেশের ব্যাংকের মতো অনিয়ম-দুর্নীতি কিংবা সুশাসনের অভাবের জন্য বন্ধ হয়নি। তারপরও বন্ধ হয়েছে। ফলে শিক্ষাটা এই জায়গায় বেশি নিতে হবে। তারা সঠিক সময়ে সঠিক চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে ওদের সতর্কতার চেয়ে আমাদের বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। এ জন্য প্রথমেই সুশাসনের যে ঘাটতি রয়েছে, সেটা দূর করতে হবে। আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে যা যা করণীয় তা করতে হবে। এটা সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাই করবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আমেরিকায় ব্যাংক ধসের প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না। কারণ, সেসব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ধরনের লেনদেন নেই। প্রতিটি দেশের ব্যাংক পরিচালনার জন্য আলাদা আলাদা নীতি রয়েছে। সরকারি নীতি এক রকম আর বেসরকারি নীতি এক রকম। সেই নীতি অনুযায়ী চলে প্রতিটি দেশ। কে কীভাবে ব্যাংক ম্যানেজ করে তার ওপর নির্ভর করে ব্যাংকে কী ধরনের প্রভাব পড়বে। সুতরাং আমেরিকায় যে ঘটনা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি আমাদের দেশে ঘটার কোনো সুযোগ নেই।