দুর্ঘটনার দায় কেউ নিচ্ছে না

উন্নয়ন মানুষের জীবনে সহজতা ও নিরাপত্তা আনবে। সেজন্য উন্নয়নের সঙ্গে টেকসই শব্দটি যুক্ত হয়েছে। দেশে ‘উন্নয়ন’ নিয়ে একতরফা আলোচনা হয়। ক্ষমতাসীনদের যুক্তি, এর জন্য গণতন্ত্র একটু সঙ্কুচিত হলেও ক্ষতি নেই। অথচ এ উন্নয়ন কোনোভাবে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ আনতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে সহজতা নিয়ে এলেও অনেক বেশি করে মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। উদাহরণ হিসেবে বিগত এক যুগে সড়ক অবকাঠামোর কথা উল্লেখ করা যায়। এ সময়ে বড় বড় সেতু, উড়াল ও সুড়ঙ্গ পথ, এমনকি মাইলের পর মাইল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একই সময় দেখা যাচ্ছে, সড়কপথে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বহুলাংশে কমেছে। গত এক যুগে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও হতাহত, পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষের হিসাব দেখলে তার স্পষ্ট প্রমাণ মিলবে। তাই অনেকের প্রশ্ন, এ ধরনের উন্নয়ন কিভাবে গ্রহণযোগ্য হবে?

গত রোববার পদ্মা সেতুর কাছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা গাফিলতি কতটা প্রকট। সরকার বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করে শুধু নিজেদের কৃতিত্ব নিতে ব্যস্ত। নিয়মনীতি ও আইনকানুন মানা হচ্ছে কি না; সে নিয়ে মনোযোগ নেই। এমনকী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নেও যাত্রী সাধারণের নিরাপত্তার কথাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়নি।

ভোর ৪টায় বাসটি খুলনার ফুলতলা থেকে ছেড়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়ন্ত্রণ হারায়। রেলিং ভেঙে ১০০ ফুট নিচে পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায়। চালক ও সহযোগীসহ ঘটনাস্থলে ১৭ জন প্রাণ হারান, ১২ জনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠাতে হয়। দুর্ঘটনা কতটা ভয়াবহ ছিল নিহতের সংখ্যা ও আহতদের আঘাত দেখে সহজেই বোঝা যায়।

ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, বাস কোম্পানি ও চালক কোনো নিয়মকানুন মানছেন না। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। ইমাদ পরিবহনের বাসটি মাত্র কয়েক মাস আগে আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল। এর রাস্তায় চলাচলের অনুমতি ছিল না। চালকের ব্যাপারে জানা যাচ্ছে, বিরামহীন গাড়ি চালানোর জন্য তিনি ছিলেন ক্লান্ত। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালিয়েছেন, পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারেননি। বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানান, বেপরোয়া গতিতে বাসটি চালাচ্ছিলেন। যাত্রীরা বারবার সতর্ক করলেও বিবেচনায় নেননি চালক। এমনকি ওই বাসের ব্রেক ঠিকভাবে কাজ করছিল না। চালক-সহকারীর আলাপে যাত্রীরা বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন।

ঘটনার বিবরণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, শতভাগ ঝুঁকি নিয়ে বাসটি চালানো হচ্ছিল। বাসের ফিটনেস, চালকের ফিটনেস কোনোটিই ছিল না। পরিবহন কোম্পানি এ ব্যাপারে কোনো সতর্কতা অবলম্বন করেনি। চালকও শুধু যাত্রাপথ দ্রুত চালিয়ে শেষ করতে চেয়েছেন; আর কিছু তার বিবেচনায় ছিল না। শুধু এই চালক ও ইমাদ পরিবহন নয়; অন্যরাও সড়কে আইনকানুনের ধার ধারেন না। এক জরিপে দেখা গেছে, পরিবহন খাতে ৮৬ শতাংশ শ্রমিক দৈনিক ১৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন, ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই।

পদ্মা সেতুসংলগ্ন এক্সপ্রেসওয়েতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকা। রেলিং ভেঙে নিচে না পড়ে বেষ্টনী থাকলে তাতে ধাক্কা খেলে ক্ষতি কম হতো বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এটিকে তারা সড়ক নির্মাণে ত্রুটি হিসেবে দেখছেন। সড়ক অবাকাঠামোয় ত্রুটি থাকার বিষয়টি মানা যায় না। বাংলাদেশে এই সড়ক নির্মাণে তুলনামূলকভাবে বিশ্বের সর্বাধিক ব্যয় হয়েছে। অন্য দিকে এ এলাকায় যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ কিলোমিটার। অথচ চালকরা ১০০-১২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। এতে নিয়মিত নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। আসলে কর্তৃপক্ষ একটি নিয়ম টাঙিয়ে দায়িত্ব পালন শেষ করেছে। নিয়ম ভাঙার জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি গত এক যুগে কয়েকগুণ বেড়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত বছর সড়কে প্রাণ গেছে সাত হাজার ৭১৩ জনের। বাস্তবে দেশের উন্নয়ন ও সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা কোনোটি ঠিকভাবে হচ্ছে না। এ জন্য যতটুকু আন্তরিকতা ও সততা দরকার সরকারের তা নেই।