
সমীকরণ প্রতিবেদন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানিকৃত বাংলাদেশে তৈরি পোশাক পণ্যের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগকে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বাংলাদেশী পোশাক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা নেমে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অভিযোগ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের জনপ্রিয় ও সুপরিচিত ব্র্যান্ডের পণ্য নকল করে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি করা হচ্ছে। এই অভিযোগ পর্যালোচনার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বিশেষ উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। এই সংস্থাটি বৈশ্বিক মেধাস্বত্ব রক্ষা ও কার্যকর দিকটা দেখভাল করে বলে জানা গেছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়ে ইউএসটিআর এর পক্ষ থেকে এই অভিযোগ এনে সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনা করার কথা জানানো হয়।
জানা গেছে, মার্কিন ব্র্যান্ডগুলোর প্রভাবশালী সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ) এবং প্যারিস-ভিত্তিক ইউনিয়ন ডেস ফেব্রিক্স (ইউনিফ্যাব)-এর অভিযোগের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নিয়েছে। এএএফএ ও ইউনিফ্যাব নকল প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের পক্ষে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকা ভিত্তিক দু’টি প্রতিষ্ঠান নকলের এই অভিযোগ তোলায় আমেরিকান বাজারের পাশাপাশি ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতেও বিপত্তি সৃষ্টি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। নকলের এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর কোটা আরোপ, নিষেধাজ্ঞা কিংবা বাড়তি শুল্কারোপ করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এই প্রথম কোনো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) বিরুদ্ধে এ ধরনের পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নকল পোশাক রপ্তানির কোনো সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল বৃস্পতিবার বলেন, ‘বিএকেএমইএ-বিজেএমইএ কোনোভাবেই এটাকে ওন করে না। আমরা সরকারকে বলেছি যে, যদি বাংলাদেশে এ ধরনের কিছু হয় এটাকে বন্ধ করার জন্য সরকারের যা করা প্রয়োজন তা করতে হবে। আমরা নির্দিষ্টভাবে বিষয়টি এখনো জানি না। কারণ স্পেসিফিকেলি আমেরিকার অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়ার ইন্ডাস্ট্রি যে অভিযোগটা করেছে তাতে বাংলাদেশসহ চায়না, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্কসহ অনেকগুলো দেশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশে কারা করছে, কে এ জন্য দায়ী এ রকম সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কিন্তু তারা দেয়নি। আমাদের অবস্থান হলো যদি এ রকম স্পেসিফিক অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই সরকার এবং বিকেএমইএ- বিজেএমই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’
এই ইস্যুতে কোনো নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জনাব হাতেম বলেন, আমরা তো বলেছি ওই ক্ষেত্রে কোন প্রতিষ্ঠান এটি করছে আমরা যদি স্পেসিফিক এমন অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে বিকেএমইএ-বিজেএমইএ বা সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাদের বিরুদ্ধে নেবে। আমেরিকার অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়ার ইন্ডাস্ট্রি এবং ফ্রান্সের একটি কোম্পানিও এ অভিযোগটা করেছে। তারা সেখানে আবার এটাও বলেছে যে, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এই জায়গাটায় এখনো প্রেফারেন্স পাওয়ার অবস্থানে রয়েছে। তবে ২০২৬ এর পরে যখন মিডল ইনকাম কান্ট্রিতে উন্নীত হয়ে যাবে তখন আর বাংলাদেশ সেই সুযোগটা পাবে না। সেই ক্ষেত্রে যেন এ বিষয়টাকে মনিটরিংয়ে নেয়া হয় এবং এ ব্যাপারে যেন সতর্ক করা হয়- এ রকম একটা চিঠি তারা ইউএসটিআরকে দিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, সরকারকে গত ১০ তারিখে যে মেইলটা দিয়েছে সেখানে ইউএসটিআর বলেছে যে, যদি এই ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে কি হতে পারে? সেখানে তারা বলেছে যে, আমেরিকান গভর্মেন্ট সেখানে ৩টা পানিশমেন্টের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এগুলো হলো- তারা কোটা আরোপ করে দিতে পারে অথবা ডিউটি বাড়িয়ে দিতে পারে। ৩ নম্বর ব্যবস্থা হলো নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিতে পারে। যদি এই ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে এই তিনটার যে কোনো একটা হতে পারে।
বিটিএমইএর নির্বাহী সভাপতি বলেন, ইউএসটিআর আমাদেরকে বলেছে অভিযোগ এখনো প্রমাণ হয়নি। এ কারণে এ ধরনের আশঙ্কা আপনাদের মাঝে আপাতত থাকা উচিত নয়। আমরা মনে করছি যে, এই ধরনের খুব খারাপ কিছু হবে না। তবে এটা একটা সতর্কতামূলক বার্তা বলে আমরা মনে করি এবং এ বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। আর সরকারকেও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে গত ১৩ তারিখ একটা রিপলাই বা রেসপন্স তাদেরকে করেছে, যেখানে সরকারের এ ব্যাপারে কি পলিসি রয়েছে, এ ক্ষেত্রে আইনে কি কি শাস্তির বিধান আছে সেগুলো জানিয়ে একটি মেইল তাদেরকে দেয়ার কথা রয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা ১০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ব্যবহ্নত প্রতি ১০টি শার্টের মধ্যে একটি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। নকলের অভিযোগ প্রসঙ্গে নিজেদের প্রদত্ত প্রাইমারি সাবমিশনে (প্রাথমিক যুক্তিখণ্ডন পত্র) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের পর্যালোচনার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের অভিযোগ তোলা যৌক্তিক নয়। পোশাক প্রস্তুতকারকরাও বলছেন, তারা কখনো এমন কাজ করেননি। তারপরও যদি অভিযোগগুলো সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি/জরিমানার মুখে পড়তে হবে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও রফতানিকারকরা।
জানা গেছে, নকলের অভিযোগের রিভিউ ৩০১ এর বিষয়টি গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন সময় ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার আগেই বাংলাদেশকে সাবমিশন পাঠাতে বলেছে দেশটি। এর প্রেক্ষিতে সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে স্টেকহোল্ডার সভায় প্রাইমারি সাবমিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে, প্রাইমারি সাবমিশনে বিস্তারিত সাবমিশন পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১৫ দিন সময় চাওয়া হবে। এ ছাড়া কাউন্টারফিট (নকল) প্রতিরোধে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার বর্ণনা থাকবে। বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, শুধু বাংলাদেশই নয়, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক রপ্তানির কোটা নির্ধারণ বা অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে পারে। তবে বাংলাদেশ এসব অভিযোগ তদন্ত করবে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ কঠোর অবস্থানে থাকবে। বিকেএমইএ নেতারা বলছেন, ‘আমরা কখনো কাউন্টারফিট করার বিষয়ে কাউকে ছাড় দেইনি, ভবিষ্যতেও দেবো না’।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ২০২২ সালে তারা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ৫৬টি নকল পণ্যের চালান জব্দ করেছে, ২০২১ সালের চেয়ে যা ৫০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত নকল পণ্য জব্দ করা হয়েছে এমন ১২টি দেশের তালিকা দিয়েছে তারা। এই দেশের তালিকার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও সৌদি আরবের মতো দেশ। মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে পরিচালিত ১৭টি অভিযানে এক লাখ ৭৫ হাজার আইটেম জব্দ করা হয়, এর শতভাগ পণ্য ছিল বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত। এএএফএ সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক নকল পণ্যের উৎস হিসেবে বিকাশের ছাড় দিলে এর এতটা ব্যাপক প্রভাব পড়বে, যা নিরসন করা কঠিন হবে। এএএফএ আরো বলেছে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন মেধাসম্পদ সুরক্ষাকে (আইপি) অগ্রাধিকার দেয়নি। এ জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি তারা বাংলাদেশকে একটি উচ্চ নজরদারি তালিকায় রাখতে বলেছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নকল পণ্য সরবরাহের অভিযোগ বাংলাদেশকে গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি হুমকির মুখে পড়বে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেন, এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ, শুল্ক বৃদ্ধি বা অন্যান্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। বিশ্বব্যাপী মেধাসম্পদ রক্ষা নিয়ে এখন অনেক ঝামেলা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-চীন টেকনোলজি ওয়ার ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের মতো ভালনারেবল দেশগুলোতে। আইপিআর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই এএএফএ এবং ইউনিফ্যাব-এর অভিযোগগুলো বাংলাদেশকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে’। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির কারণে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ডব্লিউটিওর অ্যাপিলেট ডিভিশনে কোন বিচারক নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে এবং তার বিরুদ্ধে ডব্লিউটির বিরোধ মীমাংসা আদালতে গেলে সেখান থেকে কোনো সুরাহা পাওয়া যাবে না।