তরুণদের মগজ ধোলাই : বাইয়াত নিয়ে আইএস!

সমীকরণ ডেস্ক: আই অ্যাম সোলজার অব আইএস’থ গোয়েন্দা জালে ধরা পড়ার সময় নিজের বুক চাপড়ে এমন দম্ভোক্তি প্রকাশ করে মাঠপর্যায়ের একাধিক জঙ্গি। পরে তাদের কাছে অস্ত্র-গোলাবারুদের পাশাপাশি আইএসের পোশাক ও পতাকাও পাওয়া যায়। তবে তাদের আদ্যোপান্ত ঘেঁটে দেখা যায়থ এদের কেউ জেএমবি, কেউ বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতাদের হাত ধরে জঙ্গি খাতায় নাম লিখিয়েছে। পরে তাদের আইএস নেতাদের বাইয়াত (অঙ্গীকার বা শপথ) নিয়ে এ সংগঠনের তকমা পরিয়ে দেয়া হয়েছে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি কয়েকজন জঙ্গি ধরা পড়ার সময় নিজেদের ‘আইএস (ইসলামিক স্টেট) সোলজার’ দাবি করে এবং তারা মৃত্যুকে পরোয়া করে না বলেও দম্ভোক্তি প্রকাশ করে। পরে খোঁজ নিয়ে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, এরা কেউই আইএস থেকে কোনো প্রশিক্ষণ নেয়নি। এমনকি তাদের কারোই এ সংগঠন সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণাও নেই। গোয়েন্দা জালে ধরা পড়া বেশ কয়েকজন জঙ্গি বিষয়টি স্বীকার করে জানায়, তারা আইএসের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য সিরিয়া কিংবা অন্য কোথাও কখনো যায়নি। এমনকি এ সংগঠনের কোনো নেতার সঙ্গেও তাদের কখনো কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে তারা আইএসের সর্বোচ্চ নেতা আবু মোহাম্মদ আল-আদানির বাইয়াত গ্রহণ করেছে। যদিও কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে আত্মগোপনে থাকা আল-আদানির সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না করেই তারা কীভাবে বাইয়াত গ্রহণ করেছে তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেনি। তবে তাদের দাবি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাত ধরে বাইয়াত গ্রহণের নিয়ম থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় তা না করেও শপথ নেয়া বা অঙ্গীকার করার সুযোগ রয়েছে। তাই তারা ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুব্ধ হয়ে ধ্যানমগ্ন মনে তাকে আসীন করে বাইয়াত নিয়েছে। জঙ্গি গডফাদাররা তাদের এ পথ দেখিয়ে দিয়েছেন বলে আটক জঙ্গিরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে।
গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, আইএসের শীর্ষ নেতা আবু মোহাম্মদ আল-আদানি তার সমর্থকদের সিরিয়ায় না গিয়ে নিজ নিজ দেশে জিহাদ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালানো দুঃসাধ্য হলে ‘লোন উলফ অ্যাটাকের’ কথা বলেছেন। যদি বোমা বা গুলি করে হত্যা করা সম্ভব না হয়, তাহলে পাথর মেরে মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে; জবাই করে কিংবা গাড়ি তুলে দিয়ে হত্যার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে গডফাদাররা তাদের বুঝিয়েছেন। তাই এ নির্দেশ অনুযায়ী তারা একের পর এক গুপ্তহত্যা চালিয়েছে। সুযোগ বুঝে গুলশান হামলার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে। তারা একই ধরনের আরো হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে স্বীকার করে আটককৃত ওই জঙ্গিরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কথিত বাইয়াতের নামে জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এটিবি) নেতারা এসব তরুণকে এমনভাবে মগজ ধোলাই করেছে, যে ধর্মীয় যৌক্তিক ব্যাখ্যাও তারা নিঃসংকোচে অবজ্ঞা করছে। এদিকে এসব তরুণ জঙ্গি তাদের অন্ধকার পথে পা রাখার ঘটনাচিত্র সবিস্তারে বর্ণনা করলেও জঙ্গি গডফাদারদের নাম-পরিচয় ও অবস্থান সম্পর্কে মুখ খুলছে না। তবে জিজ্ঞাসাবাদের আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে গোয়েন্দারা এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করেছেন।
আটককৃত জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, ধর্মীয় নানা ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের বিকৃত মানসিকতার পরিবর্তন করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করা হচ্ছে। এতে এক সময় তারা কিছুটা দুর্বল হয়ে জঙ্গি গডফাদারদের সম্পর্কে মুখ খোলার কথা স্বীকার করলেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে কিংবা চোখ বন্ধ করে থেকে আবার তারা আগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। এদের অনেকেই এভাবে মোহাবিষ্ট যে, তারা নিজেরাই তাদের গুলি করে হত্যার জন্য গোয়েন্দাদের অনুরোধ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আইএস নামধারী এ আত্মঘাতী কিলার গ্রুপের একটি বড় অংশ জেএমবির সৃষ্টি। এ ছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, হরকাতুল জিহাদ ও আনসার আল-ইসলামসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন তাদের দলে ভেড়ানো তরুণদের আইএসের বাইয়াত বানিয়েছে। তবে যাদের মধ্যে ততটা হিরোইজম ইমেজ নেই তাদের দেশীয় জঙ্গি নেতাদের বাইয়াত গ্রহণ করিয়ে দলে সম্পৃক্ত রাখা হয়েছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে।
এদিকে এতদিন শুধু কথিত আইএসের প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের ধরতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর থাকলেও সম্প্রতি বাইয়াত নিয়ে দলে ভেড়ানোর তথ্য উদ্ঘাটিত হওয়ার পর গোয়েন্দা মহলে নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। তাদের ভাষ্য, শুধু বাইয়াত নিয়ে দলে ভিড়ে তরুণ-তরুণীরা নিজেরাই নিজেদের নানা জঙ্গি তৎপরতায় প্রশিক্ষিত করে তুলছে। সম্প্রতি চার নারীসহ জেএমবির প্রায় একডজন সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ জেএমবির বাইয়াত নিয়ে নিজেরাই সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করছে। এমনকি তারা নিজেদের মধ্যে দলনেতা নির্ধারণ করে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেয়ার দিকেও ঝুঁকেছে। যা ভয়ংকরভাবে উদ্বেগের বিষয় বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন।
বিষয়টি স্বীকার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, জেএমবির আত্মঘাতী গ্রুপের প্রায় দেড় ডজন কিলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর ধারাবাহিক হামলা ও গুপ্তহত্যার মিশনে ছেদ পড়লেও এ জঙ্গি সংগঠনের দুর্র্ধষ নেতাকর্মী তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি জেএমবির প্রথম সারির বেশ কজন নেতা গোয়েন্দা জালে আটকের পর তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কেরও ভয়ংকর তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, এ সংগঠনটি শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতেও ইতোমধ্যে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তারা শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের বাইরে সাধারণ গৃহিণী, অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণী ও গৃহকর্মীদের টার্গেট করে তারা সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তৃত করেছে। কেউ কেউ আবার সহায়-সম্পদ সব ফেলে পুরো পরিবার নিয়ে স্বেচ্ছায় এ দলে যোগ দিয়েছে। স্রেফ জিহাদিদের শয্যাসঙ্গী হওয়ার ব্রত নিয়ে জঙ্গি দলে নাম লেখানো তরুণীদের সংখ্যাও কম নয়। মগজ ধোলাই করে দলে টানার কাজে এরা যে সফলতা দেখিয়েছে তা রূপকথার গল্পের মতোই বিস্ময়কর বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। জঙ্গি গডফাদাররা এ দলে এখন পর্যন্ত কতজনকে পুরোপুরি ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এ সংগঠনের শক্ত শেকড় অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। তারা জানান, অস্ত্র চালনা, বোমা বিস্ফোরণ, শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরি কিংবা বড় ধরনের কোনো হামলা পরিচালনার কোনো প্রশিক্ষণ না থাকলেও শুধু সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর দিকটিতেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জঙ্গিরা। আর তাই এ কার্যক্রমে জঙ্গি নারী সদস্যদের বেশি সক্রিয় রাখা হয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে এখনো আইএসের শক্তিশালী কোনো ঘাঁটি গড়ে না উঠলেও মুসলিমপ্রধান এ দেশটি স্বাভাবিকভাবে এ জঙ্গি সংগঠনের শ্যোন দৃষ্টিতে রয়েছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাতেই দেশীয় জঙ্গিরা তাদের শক্তি-সামথ্র্যের প্রমাণ দিয়ে আইএসের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিমসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় জঙ্গি সংগঠন বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই তারা অনায়াসেই তরুণ জঙ্গিদের আইএসের বাইয়াত নেয়ার কথা বলতে পারছে। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না থাকলে এ ধরনের কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া সম্ভব হতো না বলে মনে করেন তারা।