
সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশে ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) রেকর্ড দাম বাড়াল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি ফেব্রুয়ারির জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারে রান্নার এই জ্বালানির সরবরাহ ঘাটতির মধ্যে এ দাম বাড়ানো হলো। এক মাসের ব্যবধানে গ্রাহক পর্যায়ে দুই বার বিদ্যুতের দাম ও এক বার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হলো বাসাবাড়ি ও রেস্টুরেন্ট, দোকানে রান্নার গ্যাস এলপিজি এবং অন্যতম পরিবহন জ্বালানি অটোগ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ-গ্যাসের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ সেবাপণ্যগুলো কিনতে গ্রাহকের পকেট থেকে প্রতি মাসে সরাসরি বের হয়ে যাবে হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ-গ্যাস-এলপিজির দাম বৃদ্ধির ফলে সংশ্লিষ্ট অন্য পণ্য ও সেবাগুলোর দামও বাড়বে। ভোক্তারা বলছেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই এখন চড়া। সংসারের-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অনেক খরচ কমিয়েও মাসিক ব্যয় মেটাতে পারছেন না তারা। এর মধ্যে জ্বালানি কিনতে প্রতি মাসে বাড়তি টাকা যোগ হওয়ায় জনগণের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ আরো গভীর হয়েছে। আর জ্বালানি ব্যয় বাড়ার ফলে অন্য সেবা ও পণ্যের দাম কেমন বাড়তে পারে—তা ভেবে দিশেহারা তারা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও তড়িৎ প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনেক অপচয় ও দুর্নীতি হয়েছে। অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় না করে বারবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের ওপর এটি অন্যায্য চাপ। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত। এ জন্য অপচয়, অনিয়ম কমাতে বা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু সে পথে হাঁটছে না সরকার। বরং গ্রাহকের কাঁধেই অতিরিক্ত খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নিস্তার পেতে চাইছেন কর্তৃপক্ষীয় লোকজন। অতিরিক্ত খরচের চাপ কীভাবে সামলাচ্ছেন তা ব্যাখ্যা করে একটি শিল্প গ্রুপের মধ্যসারির কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন সজল বলেন, বছরখানেক ধরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিনোদন কর্মকাণ্ড প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছেন তিনি। আগে মাসে একবার পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতেন। নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রিপশন নিয়ে মুভি-সিনেমা দেখতেন। সেগুলো বন্ধ করেছেন। দুই সন্তানের এক জনের স্কুল পরিবর্তন করছেন খরচ আরো কমাতে। তিনি বলেন, আমি মোটামুটি আয় করি। তারপরও হিসাব মিলছে না। সংসার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষের মাসিক আয় আমার চেয়ে কম। তারা কীভাবে খরচ সামলাচ্ছেন তা বোঝা কঠিন।
এলপিজির নজিরবিহীন দাম বৃদ্ধি:
গতকাল বৃহস্পতিবার বিইআরসির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত জানুয়ারি মাসে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসের ক্ষেত্রে দর ১২ কেজির সিলিন্ডারে ৬৫ টাকা কমানো হয়েছিল। দেশে গ্যাস সংযোগ নেই এমন বিপুল সংখ্যক মানুষ এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে আসছে বিইআরসি। এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এ সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি।
বিইআরসি জানায়, বেসরকারি এলপিজির মূল্য সংযোজন করসহ (মূসক/ভ্যাটসহ) দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি প্রায় ১২৫ টাকা যা আগের মাসে ছিল প্রায় ১০৩ টাকা। গাড়িতে ব্যবহূত এলপিজির (অটো গ্যাস) নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি লিটার প্রায় ৭০ টাকা যা আগে ছিল ৫৭ টাকা। সরকারি এলপি গ্যাস কোম্পানির সরবরাহ করা এলপিজির দাম বাড়ানো হয়নি। সরকারি এলপিজির সরবরাহও বাজারে তেমন নেই। সরকার গত ১৮ জানুয়ারি প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ৮২ শতাংশ বাড়ায়। তবে তখন বাসাবাড়িতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। গত জুনে নির্ধারিত মূল্যহার অনুযায়ী, বাসায় দুই চুলার মাসিক বিল এখন ১ হাজার ৮০ টাকা। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রোজিনা বেগম বলেন, তার পাঁচ সদস্যের পরিবারে মাসে ১২ কেজির দুইটি সিলিন্ডার দরকার হয়। এতে খরচ হয় প্রায় তিন হাজার টাকা। তিনি জানান, বিইআরসি এলপিজির যে দর নির্ধারণ করে তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয় সিলিন্ডার। বাজারে এক ধরনের কৃত্রিম সংকটও তৈরি করা হয়েছে। গত মাসে তিনি প্রতি সিলিন্ডার (১২ কেজি) গ্যাস কিনেছেন দেড় হাজার টাকা দিয়ে। এখন ১ হাজার ৬৫০ টাকা চাইছে খুচরা বিক্রেতারা।
এক মাসে দুই বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা:
বিদায়ি জানুয়ারি মাসে বিদ্যুতের খুচরা দাম দুই বার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৮ শতাংশ এবং খুচরা দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি ঐ মাসের প্রথম দিন থেকে কার্যকর করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখনও খুচরা বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছিল। এ দফায় মূল্যবৃদ্ধির বড় খড়গ পড়েছে হতদরিদ্র-প্রান্তিক মানুষের ওপর। এই লাইফ লাইন গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। দেশে এ শ্রেণির গ্রাহক রয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ। গত ১২ জানুয়ারিতে এ শ্রেণির জন্য আগের দাম ইউনিট প্রতি (কিলোওয়াট) ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এছাড়া কৃষি উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এ খাতে বিদ্যুতের দাম সব সময়ই অপেক্ষাকৃত কম রাখা হতো। কিন্তু এবার তা হয়নি। আসন্ন বোরো মৌসুমের আগেই সার-বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো আবাদ নিয়ে এমনিতেই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা। এর মধ্যে কৃষির সেচে ব্যবহূত বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানোয় এই শঙ্কা আরো তীব্র হচ্ছে। গত ১২ ডিসেম্বর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪ টাকা ৩৭ পয়সা করা হয়েছিল। এবার আরো ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪ টাকা ৫৯ পয়সা করা হয়েছে। কৃষিতে মধ্যমচাপে ফ্ল্যাট রেটে ৫ টাকা ৫১ পয়সা, অফপিকে ৪ টাকা ৯৭ পয়সা এবং পিক আওয়ারে ৬ টাকা ৮৯ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পের বিদ্যুতের দামও দুই দফায় বাড়িয়ে ইউনিট প্রতি ৮ টাকা ৪৯ পয়সা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ফ্ল্যাট রেটে ৯ টাকা ৪১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বৃহৎ শিল্পের তুলনায় মাত্র ২ পয়সা কম। বৃহৎ শিল্পে ফ্ল্যাট রেটে দর ধরা হয়েছে ৯ টাকা ৪৩ পয়সা।
গ্যাসের দাম উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে:
গত ১৮ জানুয়ারি যে হারে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল তাতে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদনে রেকর্ড ব্যয় বাড়বে। গ্যাসের দাম নতুন করে বৃদ্ধির কারণে জ্বালানি গ্যাসের খরচ বাবদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এবং শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে বাড়তি অন্তত ২৭ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। জ্বালানি খরচ বাড়ায় ছোট, বড় এবং মাঝারি আকারের শিল্পে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার সার্বিক দাম বাড়বে। এর আগে গত জুনে দাম সিএনজি বাদে সব শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর এ দফায় বিদ্যুৎ, শিল্পের নিজস্ব বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ), শিল্প এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য দাম বাড়ানো হয়।
সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিদ্যুেকন্দ্রে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (শিল্প কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র) খাতে গ্যাস প্রতি ঘনমিটারে দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ দশমিক ৭৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। আগে বড়, মাঝারি ও ছোট শিল্পের জন্য পৃথক মূল্যহার থাকলেও এবার তিন ধরনের শিল্পের জন্য গ্যাসের একই দর নির্ধারণ করা হয়। বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগে (হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট ও অন্যান্য) প্রতি ঘনমিটারের দাম ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।