জুনের মধ্যে বিএনপির ‘অলআউট’ কর্মসূচি

সমীকরণ প্রতিবেদন:
সরকার পতনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছে বিএনপি। দলটি চূড়ান্ত আন্দোলনে দল মত নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এক সুতায় গেঁথে এগিয়ে যেতে চায়। জানা গেছে, ১০ দফা দাবি আদায়ে অলআউট আন্দোলনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে রয়েছে। উপযুক্ত সময়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের রোডম্যাপ অনুযায়ী সরকারের বিরুদ্ধে এক দফার কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। একটি সূত্র জানায়, আপাতত জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে রুটিন কর্মসূচি দিলেও রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদের মাঝামাঝিতে কঠোর আন্দোলনে যেতে পারে দলটি। গত বছর ডিসেম্বর থেকে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। বিএনপির এই যুগপৎ আন্দোলনে সরকারবিরোধী সমমনা বেশ কয়েকটি দল ও জোট ছাড়াও বাম দল এবং পেশাজীবী সংগঠন ও সম্পৃক্ত রয়েছে। বিএনপি নেতারা জানান, আপাতত জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কর্মসূচি দিলেও দশ দফা দাবি আদায়ে চলমান এই আন্দোলনকে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, তারা এখন আন্দোলনের রুটিন কর্মসূচিতে আছেন। এরপর ‘অলআউট’ কর্মসূচিতে যাবেন। এজন্য রোজার ঈদ ও কোরবানি ঈদের মাঝামাঝি সময় মে-জুনকে বেছে নেয়া হচ্ছে। এই সময়ে ঢাকা অভিমুখে রোডমার্চ, লংমার্চের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সফলতা ঘরে আনতে চায়। এরআগে চলমান যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১০ দফা দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক রুটিন কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ইউনিয়ন ও মহানগরের পর এবার জেলায় জেলায় পদযাত্রা করবে দলটি।
বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, দমন-নিপীড়নের প্রতিবাদে, খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি বিএনপি নেতাকর্মীদের মুক্তি, গণতন্ত্রবিরোধী সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সব জেলায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার দলের ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জেলায় জেলায় পদযাত্রা করার কর্মসূচির কথা জানানো হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী জেলাপর্যায়ে পদযাত্রা সফল করতে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে কঠোর কর্মসূচির আগে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে সম্পর্ক গড়তে চায় বিএনপি। এজন্য অভিন্ন দাবিতে সাত দফার একটি যৌথ ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ। বিএনপির ১০ দফা দাবি ও ২৭ দফা রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার সমন্বয়ে নতুন এই ঘোষণাপত্র তৈরি করা হচ্ছে। এ নিয়ে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা দল, এলডিপি, জামায়াতে ইসলামী, গণফোরাম (মণ্টু) সহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্যান্য দল ও জোটের সঙ্গে বসবে বিএনপি। এরপর তা স্থায়ী কমিটিতে চূড়ান্ত করে চলতি মাসেই এই যৌথ ঘোষণাপত্র সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানানোর কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমাদের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। আরও কর্মসূচি আসবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জনগণের দুর্ভোগ মোচন এবং দেশ ও দেশের জনগণকে দুর্নীতি, অনাচার, লুট ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে বিএনপি। একইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ দেশনেত্রী খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক কারণে আটক নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে এ আন্দোলন। যা ক্রমান্বয়ে বেগবান হয়ে অবৈধ সরকারকে পদত্যাগে ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করবে। অবশ্য মানুষ প্রস্তুত হয়ে গেছে। আন্দোলনের সফলতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘কর্মসূচিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলা-বাধার পরও নেতাকর্মীরা মাঠ ছেড়ে যাননি যাবেনও না। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নেতাকর্মীরা বেশি ঝুঁকি নিয়ে কর্মসূচি পালন করছেন। অনেক বেশি সাধারণ মানুষ অংশ নিচ্ছেন। নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের এ ধরনের সাহসিকতা বড় আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণে আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে। তিনি বলেন, আগামীতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আমাদের আন্দোলনে শরিক হয়ে এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করবে ইনশাল্লাহ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা জানান, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এ বছরের শেষের দিকে নেয়ার পরিকল্পনা চলছে। মূলত বিরোধীদের আন্দোলন দমাতে এই কৌশল নেয়া হচ্ছে। তাই আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও দাবি আদায়ে আর সময় নিতে চায় না। আন্দোলনের মাধ্যমে মে-জুনেই এর একটি সুরাহা হবে। জানা গেছে, মহানগরের পর উপজেলা, থানা এবং পৌরসভায় কর্মসূচি দেয়া হবে। এরপর আবার জেলায় জেলায় কর্মসূচি শেষ করে মহানগরে কর্মসূচি পালন করা হবে। এভাবে কর্মসূচির সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে হাটুতে চায় বিএনপি। পরে মে-জুনে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। এ নিয়ে সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকেও আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরের পদযাত্রা কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে বলে মনে করেন নীতিনির্ধারকরা। বিশেষ করে মহানগরের নেতারা বিভেদ ভুলে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। যা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এখন থেকেই চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নানা কর্মকৌশল নিয়েও আলোচনা করেন নেতারা।
বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের উপজেলা, পৌর কমিটি দীর্ঘ চার বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে আহ্বায়ক কমিটি হলেও সেগুলোর কার্যক্রম বা পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার উদ্যোগ নেই। বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের পদবিহীন নেতারা বেশি কর্মসূচিতে সক্রিয় এবং অংশগ্রহণ করছে। অথচ কিছু কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন, যারা নিজেদের পক্ষে কমিটি ভাগিয়ে নিয়েছেন। তারা শুধু ছবি দেখাতে ক্ষণিকের জন্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। পরে সেই ছবি তুলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। অথচ বিভাগীয় কর্মসূচিতে সাড়ে তিন বছর যারা কমিটিতে বঞ্চিত হয়েছেন তারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সর্বাধিক লোক নিয়ে বিভাগীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়েছিল। তবে তাদের দল থেকে ধন্যবাদপত্র পর্যন্ত দেয়া হয়নি। অথচ যারা কর্মসূচিতে ফাঁকি দিয়েছে তাদের অনেকেই ধন্যবাদপত্র পেয়েছেন। এতে নেতারা অনেকেই হতাশ হয়েছেন। কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার আগে এসব বিষয়েও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দিতে হবে।
চলতি মাসে যৌথ ঘোষণাপত্র, ৭ দফা খসড়া তৈরি :
অভিন্ন দফা প্রণয়নে গত মাসে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং গণতন্ত্র মঞ্চের জোনায়েদ সাকি ও হাসনাত কাইয়ুমকে যৌথ ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা দফায় দফায় বৈঠক করে সাত দফার একটি যৌথ ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছে। যা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জোট ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আরও সংযোজন-বিয়োজন করা হতে পারে। খসড়ার উল্লেখযোগ্য দফাগুলো হচ্ছে-বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারকে পদত্যাগ, অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ/নির্বাচনকালীন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটের সুস্থ ব্যবস্থা নিশ্চিত, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। খসড়ায় আরও আছে পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী পদে কেউ আসীন হবে না, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর সাজা বাতিল, সব হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সব রাজনৈতিক কারাবন্দির অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব নির্যাতনমূলক আইন বাতিল, গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে এর আগে সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনের যথাযথ তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি ও এর দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করতে শক্তিশালী কমিশন গঠনসহ এসব অপরাধে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নারীর অধিকার এবং সব ধর্ম, জাতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগরিক মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করার নীতি প্রতিষ্ঠা, জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি এবং স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।