জীবননগরে ভাতার কার্ডে অনিয়ম আর দুনীতি!

স্বচ্ছল, স্বামী থাকতেও বিধবা ও ভুয়া প্রতিবন্ধীরা পাচ্ছেন সরকারি ভাতা
জাহিদ বাবু/মিঠুন মাহমুদ:
কে দেখবে এ অনিয়ম আর দুনীতি! একেবারে সুস্থ ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শরীরে নেই কোনো প্রতিবন্ধকতা, এমন মানুষ জীবননগর সমাজসেবা কার্যালয়ের জরিপে প্রতিবন্ধী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, স্বামী থাকতেও দেওয়া হচ্ছে বিধবা ভাতার কার্ড। সম্প্রতি জীবননগর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের এ ধরনের সুস্থ মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। যারা প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি ভাতা উত্তোলন করেছেন। জীবননগর উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কর্মচারী, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও কিছু দালাল মিলে সচল ব্যক্তিদেরকে অচল বানিয়ে, স্বামী থাকতেও বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভাতা প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি কমিটি থাকবে। ওই কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকবেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। সদস্য হিসেবে থাকবেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের দুজন প্রতিনিধি (একজন পুরুষ ও একজন মহিলা), উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের একজন প্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একজন প্রতিনিধি, ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সদস্যরা এবং ওই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে থাকবেন ইউনিয়ন সমাজকর্মী। উপরোক্ত কমিটি অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রার্থী বাছাই করে তালিকা প্রণয়ন করবেন। এরপর প্রণীত তালিকা চূড়ান্ত অনুমোদনের লক্ষ্যে সুপারিশসহ উপজেলা কমিটির নিকট পাঠাবেন। কিন্তু উথলী ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপজেলা কমিটির নিকট ২১ জুলাই পাঠানো ১২০ জনের তালিকার ক্ষেত্রে নীতিমালার কোনো কিছুই অনুসরণ করা হয়নি। এনিয়ে জীবননগর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, ‘প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে যেসব ব্যক্তির নামের তালিকা দেওয়া হয় এবং ডাক্তার যাদের সুপারিশ করে দেন, কেবলমাত্র তাঁদেরকে ভাতাভোগীর আওতায় আনা হয়। তাছাড়া উথলী ইউনিয়নসহ কয়েকটি ইউনিয়নে যে ঘটনা ঘটেছে, এটা ওইসব ইউনিয়ন পরিষদ থেকে রেজ্যুলেশন করে পাঠানোর পর তাদের কার্ড দেওয়া হয়েছে এবং উথলী ইউনিয়নের ১২০ জনের ভেতর ২৫ জন সুস্থ ব্যক্তির নাম তালিকায় ছিল। তবে ধরা পড়লে তাদের স্থলে প্রকৃত প্রতিবন্ধীদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সীমান্ত ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে স্বামী থাকতেও যে বিধবার ভাতা তুলেছে এবং প্রতিবন্ধী না হয়েও যাকে প্রতিবন্ধীর কার্ড দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করব। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা গেছে, জীবননগর উপজেলার উথলী ইউনিয়নের উথলী গ্রামের একেবারে সুস্থ মানুষ জসিম উদ্দীন ও তাঁর স্ত্রীকে প্রতিবন্ধী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উথলী ইউনিয়ন সমাজকর্মী শামীম আলী অর্থের বিনিময়ে তাঁদেরকে প্রতিবন্ধী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁরা সম্প্রতি ভাতার টাকাও উত্তোলন করেছেন। সন্তোষপুর গ্রামের বাবলু মল্লিক, মোশারেফ হোসেন, রায়হান উদ্দীন, জামাল হোসেন, আনারুল হোসেন এরা একবারে সুস্থ এবং এদের শরীরে কোনো প্রতিবন্ধকতার চি‎হ্ন নেই। অথচ ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. সেলিম হোসেন ইউনিয়ন সমাজকর্মী শামীম আলীকে সুপারিশ করে তাঁদের প্রতিবন্ধী তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়ন সমাজকর্মী। কিন্তু ওই গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী বলেন, কর্মক্ষম ও সুস্থ হলেও অন্যায়ভাবে প্রতিবন্ধী উপকারভোগীর কার্ড হওয়ার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুস্থ ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধী সাজিয়ে তাঁদের নামে উপকারভোগীর কার্ড হওয়ার ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ হলে উপজেলাজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। একই অভিযোগ উঠেছে ৪ নম্বর সীমান্ত ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার আদুরীর বিরুদ্ধে। মোটা অংকের অর্থ নিয়ে গোয়ালপাড়া গ্রামের রকিমের স্ত্রী তহুরা খাতুন একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি হলেও তাঁকে দেওয়া হয়েছে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড। একই গ্রামের হাসুরা খাতুনের স্বামী সেলিম হোসেন জীবিত থাকলেও তাঁকে দেওয়া হয়েছে বিধবা ভাতার কার্ড। বয়স না হলেও হিমচান চৌকিদারকে দেওয়া হয়েছে বয়স্ক ভাতার কার্ড। ইতোমধ্যেই সবাই টাকা উত্তলন করেছেন।
তাছাড়া আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নে হয়েছে চরম অনিয়ম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিযোগ করে বলেন, আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক দুই মেম্বারের বয়স না হলেও তাঁরা বয়স্ক ভাতা তুলছেন। এমনকি ইউপি সদস্যদের কারসাজিতে এবং চেয়ারম্যানের দাপটে আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড নিয়ে অনিয়ম এবং দুর্নীতি হলেও চেয়ারম্যানের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না।
এ ব্যাপারে সমাজকর্মী শামীম আলী বলেন, ‘আমার চাকরি অল্পকিছু দিন হয়েছে। অভিজ্ঞতা কম, এ জন্য ভুল হয়েছে।’ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ভুল হয়েছে এ রকম আর হবে না।
এ ব্যাপারে উথলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি ইউনিয়ন সমাজকর্মী শামীম আলীকে নীতিমালা অনুযায়ী তালিকা প্রণয়ন করতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি সেটা না করে তাঁর ইচ্ছামতো তালিকা তৈরি করেছেন। আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এ কারণে পরবর্তীতে আমার আর মিটিং করা সম্ভব হয়নি।’
এ বিষয়ে জীবননগর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, জরিপ চালিয়ে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সব প্রতিবন্ধীর একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। একজন চিকিৎকের দেওয়া সনদপত্র ও নানা তথ্য একত্রিত করে প্রতিবন্ধী উপকারভোগীদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এখানে কিছু ভুলত্রুটি হতে পারে। তবে ভুলত্রুটি ধরা পড়ার পর তাৎক্ষণিক শোধরানো হয়। তবে যদি কেউ ইচ্ছা করে একেবারে সুস্থ ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড করে দেন, সে ক্ষেত্রে তদন্তের পর দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জুলিয়েট পারউইন বলেন, ‘আমি প্রতিবন্ধীদের কাগজপত্র এবং তাদের পরীক্ষা করেই সুপারিশ করে থাকি। যারা প্রতিবন্ধী নয়, তাদের কেন সুপারেশ করব। তাছাড়া সরকার যে নিয়মানুযায়ী প্রতিবন্ধীদের যাচাই-বাছাই করতে বলেছে, সে নিয়মের মধ্যে যারা আছে, তাদেরকে প্রতিবন্ধী হিসেবে আমরা সুপারিশ করে থাকি। আমি একা এ কাজ করে থাকি। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে হয়ত কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে আমার জানা মতে, আমি কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধীর সুপারিশ করিনি।’
জীবননগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এবার নতুন করে প্রতিবন্ধী ভাতার প্রার্থী বাছাই করার সময় আমার প্রতিনিধি দেওয়ার কথা হয়েছে। আগে আমার কোনো প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি। এছাড়া মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে সুস্থ মানুষকে প্রতিবন্ধী ভাতার সুবিধা পেতে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’