
সমীকরণ ডেস্ক: তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জনস্বার্থবিরোধী ও বেআইনি বলে মন্তব্য করেছেন গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা। এতে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা অংশ নেন। তারা মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালেও বিনিয়োগকারীদেরকে তার তেমন কোনো লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে না। কোম্পানি এখন দ্বিগুণের চেয়েও বেশি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এটা অযৌক্তিক ও জনস্বার্থবিরোধী। গণশুনানিতে তোপের মুখে পড়েন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও তিতাসের কর্মকর্তারা। গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো গ্যাসের মূল্য পরিবর্তন প্রস্তাবের বিষয়ে রাজধানীর টিসিবি মিলনায়তনে এ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এদিন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান এ আর খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির সদস্য মাসুদুল হক ও রহমান মোর্শেদ, তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান, তিতাসের পরিচালক (অর্থ) শংকর কুমার দাসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গণশুনানিতে জেরায় অংশগ্রহণকারীরা তিতাসের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এক পর্যায়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান বিনিয়োগকারীদেরকে ‘তথাকথিত’ বিনিয়োগকারী হিসেবে আখ্যায়িত করলে উপস্থিত বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। হৈচৈ শুরু করেন অনেকেই। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান বিষয়টি বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে তিনি ‘তথাকথিত’ বলে উল্লেখ করেছেন বলে ব্যাখ্যা দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। গণশুনানিতে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ডিএসই’র পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায়। গ্যাসের দাম বাড়ালেও বিনিয়োগকারীদেরকে কোম্পানিটি তেমন কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। নামমাত্র ১৫ শতাংশ পেয়েছেন তারা। কোম্পানি এখন দ্বিগুণের চেয়েও বেশি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। গণশুনানিতে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল ইসলাম শুরুতেই তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে জেরা করেন। তিনি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত ২৪টি প্রশ্নের ব্যাখ্যা চান কোম্পানিটির কাছে। অনেক প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারেনি তিতাসের কর্মকর্তারা। প্রথমে প্রশ্নে বলেন, গত ১লা সেপ্টেম্বর থেকে বিইআরসি’র গ্যাসের মূল্যহার বৃদ্ধির আদেশ কার্যকর হয়েছে। সেই সঙ্গে পুনঃনির্ধারিত বিতরণ মার্জিন কার্যকর হয়েছে। আইওসি গ্যাসের প্রকৃত ক্রয়মূল্য, উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রকৃত রাজস্ব চাহিদা এবং ভবিষ্যৎ উচ্চ মূল্যের এলএনজি ক্রয়ের মাধ্যমে জ্বালানি ঘাটতি মোকাবিলার জন্য সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক বিইআরসিতে গত ২৯শে মার্চ গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যহার ও বিতরণ মার্জিন বৃদ্ধির আবেদন করা হয়। তিনি সরকারি সে নির্দেশনাটি দেখতে চান। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবদুল মতিন বলেন, শিল্প-কারখানা চলতে পারছে না। ইউটিলিটি যদি ১৪ শতাংশ বাড়ে তাহলে কারখানা কিভাবে চলবে। গণশুনানিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, তিতাস গ্যাস ডি?স্ট্রি?বিউশন কোম্পানির গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জনস্বার্থবিরোধী ও বেআইনি। তিতাসের সিস্টেম গেইন একটা শুভংকরের ফাঁকি। যেখানে গ্যাস ব্যবহার হয় না, সেখানে ব্যবহার দেখানো হয়। আর যেখানে গ্যাসের লো প্রেসার পাওয়া যায় কিন্তু বিল নেয় হাই প্রেসারের। গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গ্যাসখাত যদি ব্যবসার পেছনে ঘুরে তাহলে মানুষের মৌলিক বিষয় আর থাকছে না। গ্যাসের দাম গত সেপ্টেম্বরে বাড়ানো হলো। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আবার কেন দাম বাড়ানোর প্রস্তাব। এতে জনগণের অবস্থা খারাপ হবে।
তিতাস গ্যাসের বিতরণ চার্জ ২ পয়সা কমানোর সুপারিশ: তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের বিতরণ চার্জ ২ পয়সা কমানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসির টেকনিক্যাল ক?মি?টি। বর্তমান চার্জ দশ?মিক ২৩১ টাকা বা ২৩ পয়সা থেকে কমিয়ে দশমিক শূন্য ২১ টাকা বা ২১ পয়সা করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে তিতাস চার্জ বাড়িয়ে ১ টাকা ০৩৮ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তিতাস কোম্পানিটি সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিটি আবাসিকে একচুলার মাসিক বিল ৬ শ’ টাকা থেকে ৮৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ শ’ টাকা, দুই চুলা ৬৫০ টাকা থেকে ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শ’ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে মিটারযুক্ত আবাসিক গ্রাহকদের ১৪০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ৭ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৬ দশমিক ৮০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। বাড়ানোর তালিকায় মিটারযুক্ত আবাসিকের পরেই রয়েছে ক্যাপটিভ পাওয়ার। এই খাতে ১৩০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে তিতাস গ্যাস। এই খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বর্তমান দর রয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ টাকা। দর বৃদ্ধির প্রস্তাবে ১৯ দশমিক ২৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে এখানে। এছাড়া, বিদ্যুতে ৬৩ শতাংশ, সার উৎপাদনে ৭১ শতাংশ, শিল্প-কারখানার জন্য ৬২ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ৭২ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে তিতাস গ্যাস। প্রসঙ্গত, এর আগে গত বছর আগস্টে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরে কার্যকর হয়। এদিকে, আগামীকাল ১০ই আগস্ট পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি, ১১ই আগস্ট বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানি, ১৪ই আগস্ট কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, ১৬ই আগস্ট জালালাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও ১৭ই আগস্ট সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর শুনানি গ্রহণ করা হবে। ১৮ই আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস ও বাপেক্সের সরবরাহ করা গ্যাসের পাইকারি মূল্য বাড়ানোর বিষয়ে গণশুনানি।