
সমীকরণ প্রতিবেদন:
গর্ভের আগে ও পরে নানা জটিলতায় বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৩ মা মারা যাচ্ছেন। গর্ভধারণের সময় মায়ের প্রচুর পরিমাণ খাবার প্রয়োজন হয়। এ সময় লৌহ, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের অভাব হয়ে থাকে। গর্ভধারণে অথবা সন্তান জন্মদানে বেশির ভাগ মা মারা যায় স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলার কারণে। আবার গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম কুসংস্কার। তারা মনে করেন বেশি করে ভিটামিন অথবা অন্যান্য ওষুধ খেলে গর্ভের শিশু মোটা হয়ে যাবে। তাহলে প্রসবজনিত সমস্যা বেশি হবে। এসব কারণে গর্ভবতী মহিলারাও ওষুধ খেতে চান না। ২০০১ সালের মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপে ২০ শতাংশ নারীর মৃত্যুর কারণ ছিল মাতৃত্বসংক্রান্ত। ২০১০ সালে মাতৃত্বসংক্রান্ত কারণে মাতৃমৃত্যু ১৪ শতাংশে নেমে যায়। ১০ বছরের ব্যবধানে মাতৃমৃত্যু কমে ৬ শতাংশ। ২০২০ সালের মাতৃমৃত্যু জরিপ বলছে, গড়ে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা মাতৃত্বকালীন জটিলতায় বেশি মারা যাচ্ছেন। আমাদের দেশে গ্রাম অথবা শহর উভয় এলাকায় গর্ভবতী মায়েরা প্রয়োজন মতো ওষুধ পান না। তারা ওষুধ ও চিকিৎসা পায় না যে শুধু অর্থের অভাবে, তা নয়। গ্রামাঞ্চলের এমনকি শহরাঞ্চলের অনেক অভিভাবকরা মনে করেন, গর্ভকালীন অথবা প্রসবে তাদের মা, দাদীদের কোনো ওষুধ লাগেনি, ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি। এখন কেন লাগবে? গর্ভবতী নারীদের প্রতি অভিভাবকদের মধ্যে অজ্ঞতার সাথে সাথে গর্ভবতী নারীদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম কুসংস্কার। তারা মনে করেন, বেশি করে ভিটামিন অথবা অন্যান্য ওষুধ খেলে গর্ভের শিশু মোটা হয়ে যাবে। মোটা শিশু মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না স্বাভাবিকভাবে। এসব কারণে গর্ভবতী নারীরাও ওষুধ খেতে চান না বলে জানিয়েছেন গাইনি অ্যান্ড অবসটেট্রিকের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: শারমিন আক্তার।
শারমিন আক্তার বলেন, কম আয় করে এমন পরিবারের নারীরা প্রসব পূর্ববতী কোনো চিকিৎসা কম পায়। অপর দিকে আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো এমন ২২ শতাংশ গর্ভবতী মা প্রসব পূর্ববর্তী সেবা পায় না। আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো যে গর্ভবতী মায়েরা প্রসব পূর্ববর্তী চিকিৎসাসেবা (এএনসি) পায়না তারা কুসংস্কারে ভোগে থাকেন। দেশে যে ক’জন গর্ভবতী মা বছরে মারা যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই বাড়িতে অদক্ষ দাইয়ের হাতে প্রসবের ব্যবস্থা করেন।
ডা: শারমিন বলেন, নিরাপদ মাতৃত্বের অভাবে গর্ভবতী মায়েরা যে জটিলতায় ভোগেন তার কারণ- মানুষের মধ্যে অপর্যাপ্ত জ্ঞান, পারিবারিক ও সামাজিক বিশ্বাস, সেবা পাওয়ার কেন্দ্র অনেক দূরে থাকা, দূরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত যাতায়াত সুবিধা না থাকা এবং দরিদ্র মানুষের কাছে চিকিৎসার খরচ বহন করার মতো পর্যাপ্ত টাকা না থাকা। ২০০৭ এর বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) মতে বাংলাদেশে মাত্র ১৮ শতাংশ নারী প্রসবের সময় দক্ষ দাইয়ের সেবা পান। দক্ষ দাইদের ৫ শতাংশের কোনো লেখাপড়া নেই, ৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপ্ত করতে পারেননি এবং ১৩ শতাংশ সমাপ্ত করেছে মাত্র। ২৭ শতাংশ মাধ্যমিক পাস এবং ৪৭ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে অথবা পড়েছে কিন্তু পাস করতে পারেনি। বিডিএইচএসের ২০০৭ এর তথ্য মতে, কেবল মাত্র ২৭ শতাংশ মা প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। ৭০ শতাংশ মা কিংবা নবজাতক কোনো চিকিৎসা সেবা পাননা প্রসবের পরে অথবা জন্মের পরে। ২০০১ সালের মাতৃমৃত্যু জরিপে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের হার ছিল মাত্র ৯ শতাংশ, ২০১০ সালে তা হয় ২৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের জরিপে তা হয়েছে ৪৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৫৩ শতাংশ মায়ের অদক্ষ প্রসব সহায়তাকারীর হাতে অনিরাপদ প্রসব হচ্ছে। সারা দেশে শুধু ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করে।