ক্ষুর কাঁচিতেই শান্তাবাইয়ের জীবন

Khur Kaichi

বিস্ময়কর ডেস্ক: শান্তাবাই শ্রীপতি যাদব। মহারাষ্ট্রের কোলাপুরের হারুসাগিরি গ্রামে বাস করেন। হঠাৎ স্বামীর মৃত্যু সবকিছু উলটপালট করে দেয়। চার সন্তানদের মুখে পর্যাপ্ত খাবার তুলে দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিজের চার মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরই বদলে যায় জীবন। ভারতের মহারাষ্ট্রের কোলাপুরের হারুসাগিরি গ্রামের বাসিন্দা শান্তাবাইয়ের বাবা এবং স্বামী দুজনেই ছিলেন নাপিত। স্বামী শ্রীপতির তিন একর মতো জমি ছিল। কিন্তু নিজের ভাইদের সঙ্গে বিবাদের জেরে জমি ভাগাভাগি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত শান্তার স্বামী নিজের ভাগে এক একরেরও কম জমি পান। সংসারের অভাব মেটাতে ধার করতে শুরু করেন স্বামী। এক সময় ধারের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দেউলিয়া অবস্থা হয়। নিজেদের গ্রাম ছেড়ে হাসুরাসাসগিরি গ্রামে গিয়ে থাকতে শুরু করেন শান্তারা। একে একে ছয়টি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন শান্তা।  তার মধ্যে অবশ্য শিশু অবস্থাতেই দুজনের মৃত্যু হয়। কিন্তু তারপরও স্বামী শ্রীপতি নাপিতের কাজ করে ভাল উপার্জন করত। সংসারে অভাব ছিল না। হঠাৎ ১৯৮৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শ্রীপতির মৃত্যু হয়। শান্তার বড় মেয়ের বয়স তখন আট বছর, ছোট মেয়ের বয়স এক বছরের মতো। উপায় না পেয়ে শান্তা স্বামীর মৃত্যুর পরের তিন মাস কৃষি কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। আট ঘণ্টা কাজ করে সামান্য উপার্জন হতো। এই উপার্জনে চার সন্তানকে নিয়ে সংসার চলছিল না। কেউ তাদের সহযোগিতাও করছিল না। এক পর্যায়ে সন্তানদের মুখে পর্যাপ্ত খাবার তুলে দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিজের চার মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন শান্তা। তখনই পরিচিত একজনের পরামর্শে স্বামীর পেশাকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেন শান্তাবাই। শান্তার স্বামীর মৃত্যুর পরে ওই গ্রামে আর কোনো নাপিত ছিল না। প্রথমে অবশ্য নাপিত হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন শান্তা। কারণ, মহিলা নাপিত হিসেবে কারও কাজ করার কথা শোনা যায়নি। কিন্তু, এই পেশাকে বেছে নেওয়া ছাড়া শান্তাবাইয়ের কাছে বিকল্প কোনো পথও ছিল না। হরিভাই কাদুকর নামে গ্রামের যে সভাপতি তাকে নাপিত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনিই শান্তার প্রথম গ্রাহক হন। শান্তা বলেন, প্রথমদিকে মহিলা হিসেবে নাপিতের কাজ করার জন্য গ্রামবাসীরা অনেক টিটকিরি করত। অনেকেই ভালো চোখে দেখত না। কিন্তু কিছুতেই দমে যাননি শান্তা। নিজের মেয়েদের প্রতিবেশীর বাড়িতে রেখে দিনে চার-পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে ঘুরে লাগোয়া গ্রামগুলিতে গিয়ে নাপিতের কাজ করতেন। ধীরে ধীরে শান্তার কথা আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। যে গ্রামগুলিতে কোনো নাপিত ছিল না, সেখানে সহজেই ক্রেতা পেয়ে যান শান্তা। নিজের কাজের জন্য বিভিন্ন সংস্থার থেকে স্বীকৃতিও পান তিনি। ১৯৮৪ সালে প্রথম যখন নাপিত হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন চুল এবং দাড়ি কাটার জন্য এক টাকা পারিশ্রমিক নিতেন। গবাদি পশুর ক্ষৌরকাজ করার জন্য পাঁচ টাকা নিতেন তিনি। নাপিত হিসেবে কাজ করেই নিজের মেয়েদের বড় করে বিয়ে দিয়েছেন শান্তা। এখন তার দশজন নাতি, নাতনি রয়েছে। কিন্তু বয়সের ভারে এখন আর গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাজ করতে পারেন না শান্তা। তা ছাড়া গ্রামে এখন সেলুনও হয়েছে। অল্প বয়সি ছেলেরা সেখানেই যায়। কিন্তু বয়স্ক এবং গ্রামের পুরনো বাসিন্দারা শান্তার কাছেই আসেন। এক টাকা পারিশ্রমিকে কাজ শুরু করা শান্তা এখন চুল এবং দাড়ি কাটার জন্য পঞ্চাশ টাকা পারিশ্রমিক নেন। আর গবাদি পশুর ক্ষৌরকাজ করলে ১০০ টাকা পারিশ্রমিক নেন তিনি। যদিও, এখন নাপিত হিসেবে কাজ করে মাসে তিনশো থেকে চারশো টাকার বেশি উপার্জন হয় না। এ ছাড়া সরকারি ভাতা হিসেবে মাসে ৬০০ টাকা পান শান্তা। এই সামান্য আয়ে তার সংসার চলে না। শান্তাবাইয়ের বিশ্বাস, যেভাবে জীবনের কঠিন সময় কাটিয়ে উঠেছেন, সেই একইভাবে এই লড়াইতেও জয়ী হবেন তিনি। শান্তা বলেন, নাপিত হিসেবে কাজ করেই নিজেকে এবং নিজের সন্তানদের নতুন জীবন দিতে পেরেছেন। তাই যতদিন চোখে দৃষ্টি রয়েছে এবং হাতে ক্ষুর ধরতে পারছেন, ততদিন তিনি কাজ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যাবতীয় কৃতিত্ব হরিভাই কাদুকরকে দিতে চান শান্তাবাই। কারণ তাঁর পরামর্শেই নাপিত হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ভারতের প্রথম মহিলা নাপিত শান্তাবাই শ্রীপতি যাদব। বয়স এখন ৭০ বৎসর। এ বয়সেও ক্ষুর-কাঁচি এখনও চলছেই।