ক্ষতি পোষাতে প্রায় ১২৯ কোটির প্রকল্প

করোনায় প্রাথমিকের ৪ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন স্থবির
সমীকরণ প্রতিবেদন:
করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যায়ে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। বড় ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের শিখন-শেখোনোর কার্যক্রম। বেড়ে যাবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ও বাল্যবিয়ের হার। আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তির হার কমে যেতে পারে। করোনায় শিক্ষার এসব সম্ভাব্য ঝুঁকি উত্তরণে সরকার ১২৮ কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ স্কুল সেক্টর রেসপন্স’ (সিএসএসআর)। চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদ ধরা হয়েছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। গ্লোবাল অনুদান হিসেবে পার্টনারশিপ ফর এডুকশেন (জিপিই) অর্থায়ন করবে ১২৬ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা আর বেতন ভাতা হিসেবে সরকার অর্থায়ন করবে মাত্র এক কোটি ৮৭ লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হলেও পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, করোনা বিশ্বব্যাপী শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে অর্থায়ন করছে পার্টনারশিপ ফর এডুকশেন (জিপিই) নামে সংস্থাটি। সেখান থেকে অর্থ পেতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার চেয়ে আবেদন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৫ মিলিয়ন বা ১২৬ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়। তবে বাংলাদেশে সংস্থাটির কোনো অফিস না থাকায় বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাড় হবে। তবে মনিটরিং করবে জিপিই। জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় নতুন শিক্ষাবর্ষে স্কুলে ভর্তি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে (পরীক্ষা) ও লেখাপড়ার ক্ষতি পূরণে সহায়তা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সেবা প্রদান, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলার জন্য বিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা, দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখা এবং মূল বিদ্যালয়ের সাথে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে একীভূত করা, জরুরি পরিস্থিতি তথা দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের পরিস্থিতিতে কৌশল ও মানসম্মত পরিচালনা কার্যপ্রণালী প্রণয়নে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হবে। এছাড়াও যখনই স্কুল খোলা হবে তখন প্রায় ২০ হাজার প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হবে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে বিশেষ স্কিম। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) রতন চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, সারাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রকল্পটি আনতে হয়েছে। আমরা যেসব প্রস্তাব দিয়েছি সেগুলো জিপিইর পছন্দ হয়েছে বিধায় তারা এত ধরনের অনুদান দিয়েছে। এ প্রকল্পটি করোনায় শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে সরকারের নানা উদ্যাগকে দারুণভাবে সহযোগিতা করবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য হচ্ছে কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলা এবং উত্তরণের জন্য বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত করোনা সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলার জন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে (১২ লাখ ৪৫ হাজার লাখ এবং ১২ লাখ ৯৫ হাজার ছাত্রী) একীভূত দূরশিক্ষণ (টিভি, রেডিও ও অলাইন) সহায়তা দেয়া। এছাড়াও ৩২ লাখ ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে (১৫ লাখ ৯০ হাজার ছাত্র ও ১৬ লাখ ৫০ হাজার ছাত্রী) প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের সরকারি বিদ্যালয়ে পুনঃভর্তি (যারা চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিল) নিশ্চিত করা। মূল বিদ্যালয় ব্যবস্থার সাথে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে পুরোপুরি কার্যকর ও একীভূত করা। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির পুরো শিক্ষাবর্ষের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ ডিজিটাল কনটেন্ট সমৃদ্ধ ৩৫টি বিষয়ের কার্যক্রমের (সাবজেক্ট প্রোগ্রাম) সহায়তা করা। এক লাখ ৫০ হাজার দুর্গম এলাকার শিশুর শিক্ষা উপকরণ দেয়া। স্কুল বন্ধ থাকায় ১৫ লাখ শিশু শিক্ষার্থীকে করোনার নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণ করতে উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণা ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ।
নিরাপদে ফের স্কুল খুলতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ২০ হাজার স্কুল খোলা। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি করা। স্কুল বন্ধের কারণে শিক্ষার ক্ষতি পরিমাপ করতে তিন লাখ ৫০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা। দুই লাখ শিক্ষককে প্রতিকারমূলক শিক্ষা, দূর শিক্ষণ কৌশল এবং সামগ্রমিক ও সামস্টিক মূল্যায়ন চর্চা এসব বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা। দূরশিক্ষণ ব্যবস্থার জন্য স্থায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সরকারের নিয়মিত কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্তকরণ। মূল বিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য মানসম্মত জরুরি পরিচালনা কার্যপ্রণালী তৈরি করা এবং শিখন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সরাসরি ইন্টারভেশন থেকে তিন কোটি ৫৯ লাখ শিক্ষার্থী উপকৃত হবে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হবে— স্কুল বন্ধ থাকায় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য কনটেন্ট তৈরি ও বিতরণ করা। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয় জনগণের সাথে যোগাযোগ এবং জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রহণ। সরকারি নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ফের স্কুল চালু করার পরিকল্পনা তৈরি করা। নিরাপদে স্কুল চালু করতে তৈরি করা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করা। করোনার সংকটে যেসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তাদের আবার স্কুলে ভর্তিতে সহায়তা করা। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে (পরীক্ষা) ও লেখাপড়ার ক্ষতি পূরণে সহায়তা করা। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সেবা প্রদান। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলার জন্য বিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা। দূরশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং মূল বিদ্যালয়ের সাথে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে একীভূত করা। জরুরি পরিস্থিতি তথা দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের পরিস্থিতিতে কৌশল ও মানসম্মত পরিচালনা কার্যপ্রণালী প্রণয়ন। সকল কার্যক্রমের কারিগরি সহায়তা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা। স্কুল খোলার জন্য আন্তর্জাতিক নির্দেশনায় যা বলা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম— বিদ্যালয় খোলার ঘোষণা দেয়ার অন্তত ১৫ দিন আগে শিক্ষক, কর্মচারী এবং এসএমসি সদস্যদের উপস্থিতিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করা, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ক্লাস উপযোগী করে বিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্ন করে তোলা, বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, স্কুলের গেটে বা প্রবেশের স্থানে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও পানির ব্যবস্থা করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে প্রবেশ এবং থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মেপে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করানো। গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, যখন স্কুল খোলা হবে তখনই এ প্রকল্পের সুবিধা পাবে কয়েক কোটি শিক্ষার্থী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে যেসব নির্দেশনা তৈরি হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে প্রকল্প থেকে অর্থ সহায়তা দেয়া হবে।