ক্যাসিনোর জায়গা নিচ্ছে অনলাইন জুয়া

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ক্যাসিনো বন্ধের পর তার স্থান দখল করে নিচ্ছে অনলাইন জুয়া। ভারতের শিলং থেকে পরিচালিত এই জুয়ার আসরটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশে। দেশের কোটি কোটি টাকা অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে ভারতের অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের হোতারা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়েছে এই ধরনের জুয়ার আসর। এমন খবরের ভিত্তিতে এই ধরনের জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানী ঢাকা ও নেত্রকোনা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে চার অনলাইন জুয়াড়িকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে এসেছে অনলাইন জুয়ার আসরের চাঞ্চল্যকর কাহিনী। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাসিনো জুয়ার আসর ছিল টাকাওয়ালা ধনাঢ্য মানুষদের চিত্ত-বিনোদনের জায়গা। সেখানে টাকাওয়ালারা অভিজাত জুয়ার ফাঁদে পড়ে খুঁইয়ে আসত কোটি কোটি টাকা। এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছর ক্যাসিনোর আসরগুলোতে চালানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। গ্রেফতার করা হয়েছে ক্যাসিনোর গডফাদারদের। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ক্যাসিনোর আসর। ক্যাসিনো কাণ্ডের অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের এবং গ্রেফতারের বাইরে যারা রয়ে গেছে তাদের বিচার না হওয়ার আগেই আবার শুরু হয়ে গেছে অনলাইন জুয়ার আসর। এবার অনলাইন জুয়া বা ‘তীর খেলা’র ফাঁদে পড়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষজন। বিত্তবানদের সঙ্গে এবার এই জুয়ায় জড়িত হয়েছে বিভিন্ন জেলার খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী। আর এই জুয়ার লাভের টাকা ভাগ বাটোয়ারার পর একটি অংশ চলে যাচ্ছে ভারতের শিলংয়ে। কারণ অনলাইন এই জুয়া সেখান থেকেই পরিচালিত হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার গুলশান ও নেত্রকোনা থেকে অনলাইন জুয়ার বাংলাদেশী মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত ২৯ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় চারজনকে। গ্রেফতাকৃতরা হলো- মোঃ শামীম মিয়া (৩০), আবদুল আলী (৩১), এরশাদ মিয়া (২৯) ও সোহাগ মিয়া (২৭)। এছাড়া কয়েকজনকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেফতারের সময় জুয়াড়িদের কাছ থেকে জুয়ার কাজে ব্যবহৃত ছয়টি মোবাইল, একটি রেজিস্ট্রার খাতা, ১-৯৯ পর্যন্ত নম্বর বিশিষ্ট চারটি চার্ট সংবলিত ব্যবহৃত শীট এবং পাঁচটি অব্যবহৃত চার্ট সংবলিত শীট জব্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে অনলাইনে জুয়া খেলার টাকা ভারতের শিলংয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে অনলাইন জুয়ার আসরের বর্ণনা দিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা বলেছে, অনলাইন জুয়ার ফাঁদে ফেলে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে সারাদেশেই সক্রিয়। জুয়াড়ি, সেলসম্যান ও এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এই জুয়া। সারাদেশেই ‘তীর টুডে ডটকম’র এজেন্ট ও সেলসম্যান রয়েছে অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের। ভারতের শিলং থেকে এ জুয়া পরিচালিত হয়। ভারতের শিলংয়ে দেয়া হয় ৭০ গুণ লাভ। আর দেয়া হয় বাংলাদেশে ৮০ গুণ লাভ। একজনের একাধিক সংখ্যাও কেনার সুযোগ রয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে চলছে এই জুয়া খেলা। দিনমজুর, ট্রলি ড্রাইভার, কয়লা শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীসহ স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে জুয়ার এজেন্টরা। চক্রটি প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিজয়ীরা লাভবান হলেও অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। জুয়া খেলার মাধ্যমে অর্জিত টাকা অনলাইন ব্যাংকিং সেবা বিকাশের মাধ্যমে চক্রের বিভিন্ন মহলে লেনদেন হয়। এই টাকার একটি অংশ বিভিন্ন হাত ঘুরে ভারতের শিলংয়ে জুয়া পরিচালনাকারীদের কাছে চলে যায়। অনলাইন জুয়াড়ি চক্রটি ইতোমধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ভারতের শিলংয়ের জুয়াড়িরা বাংলাদেশে এজেন্ট নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশী এজেন্টরা আবার বিভিন্ন এলাকায় তাদের সেলসম্যান নিয়োগ করে। এই সেলসম্যানদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখিয়ে শিলং তীর জুয়ায় আসক্ত করা হয়। ভারতের শিলংভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘তীর টুডে ডটকম’ ব্যবহার করে ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত নম্বরগুলো বিক্রি করা হয়। ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত নম্বরগুলো যারা কেনে তাদের সঙ্গে সেলসম্যানরা যোগাযোগ করে। তখন জুয়াড়িরা সেলসম্যানের কাছে নম্বর ও বিভিন্ন অংকের টাকা দেয়। সেলসম্যানরা বিক্রীত এ নম্বরের বিপরীতে এজেন্টের কাছে টাকা দেয়। ভারতের শিলংয়ে রবিবার ব্যতীত সপ্তাহে দুবার জুয়ার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। ড্রতে ১ থেকে ৯৯-এর মধ্যে একটি নম্বর বিজয়ী হয়। যে ওই নম্বরটি কিনেছিল তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিজয়ীরা নম্বরের ক্রয়মূল্যের ৮০ গুণ টাকা এজেন্টের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় একজন বাদে সবাই পুঁজি হারিয়ে ফেলে। জুয়াড়ি, সেলসম্যান ও এজেন্টের মধ্যে সব লেনদেন সম্পন্ন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে। সেলসম্যানরা জুয়াড়িদের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকা থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন রেখে বাকি টাকা ঢাকার এজেন্ট শামীম ও আবদুল আলীর কাছে পাঠায়। এরপর শামীম ও আলী তাদের কমিশন রেখে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা নেত্রকোনার এজেন্ট এরশাদ ও সোহাগের কাছে পাঠায়। নেত্রকোনা থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা চলে যায় সিলেটের জাফলংয়ে। জাফলং থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতের শিলংয়ে চলে যায়। এভাবে প্রতিদিন এ চক্রটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯০ সালে সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের শিলং ও গুহাটি এলাকা থেকে চালু হয় এই অনলাইন জুয়া তীর খেলা। এরপর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সিলেটের বিভিন্ন প্রান্তে। সিলেটের অনেককে সর্বস্বান্ত করে জুয়াটি বিস্তার লাভ করে নেত্রকোনা জেলায়।