লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত ও মৃত্যু : চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে জনবল সংকট
ফলোচ্যাট:
হাসপাতালে যথারীতি বেড়েছে করোনা রোগীর চাপ
অক্সিজেন সংকটে বিপাকে রোগী ও তাদের স্বজনেরা
ইয়োলো জোনের ফ্লোরেই চিকিৎসা নিচ্ছে অনেক রোগী
অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চলছে স্বজনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি
স্বেচ্ছাসেবক ও ওয়ার্ড-বয়কে টাকা দিলেই মিলছে অক্সিজেন
অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবসাও এখন তুঙ্গে
হাসপাতালে প্রতিদিন অক্সিজেনের চাহিদা এখন এক হাজার লিটারের ওপরে
মাত্রা ছাড়িয়েছে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও
এই সংকটে সদর হাসপাতালে ভেন্টিলেটর প্রয়োজন -আরএমও
রুদ্র রাসেল:
চুয়াডাঙ্গায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর হার। প্রতিদিনই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন রেকর্ড। আর এই সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সদর হাসপাতালে যথারীতি বেড়েছে করোনা রোগীর চাপও। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও এ জেলায় অনেক আগেই মাত্রা ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসার পাশাপাশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে হিমশিম অবস্থা চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আবার এরমধ্যেই সদর হাসপাতাল এলাকায় করোনা রোগীকে ঘিরে অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কিছু অসাধু মানুষ গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গে কোনো রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলেই এই সিন্ডিকেট অতিরিক্ত টকার বিনিময়ে যেমন অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করছে, ঠিক তেমনি এ জেলার বাইরে নিতে অ্যাম্বুলেন্সের মালিক-চালকেরা দাবি করছেন অতিরিক্ত ভাড়া। সবমিলিয়ে এ যেন, জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা। এদিকে, হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ইয়োলো জোনের ফ্লোর যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে শয্যা সংকটে ইয়োলো জোনের ফ্লোরেই চিকিৎসা নিচ্ছে অনেক রোগী। এরমধ্যে অনেক রোগীই সময়মতো অক্সিজেন না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। আর করোনা ইউনিটের রেড জোনের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। আর ইয়োলো জোনে অক্সিজেন সিলিন্ডার কে আগে নেবে, তা নিয়ে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলে রোগীর স্বজনদের মধ্যে। আর এই অবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অসহায়ত্বও জানান দিচ্ছে সামনের দিনগুলো কতো কঠিন হবে। হাসপাতালের চিকিৎসক-সেবিকাদের রোগীদের সেবা দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। একবার করোনা ইউনিটের আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে ইয়োলো জোনে, আবার ইয়োলো জোন থেকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। চিকিৎসক-নার্সদের এই দৌড়াদৌড়ি হাসপাতালের জনবল সংকটের স্পষ্ট চিত্র।
বিভিন্ন অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, করোনা ইউনিটে স্বেচ্ছাসেবকরা রোগীদের অক্সিজেন ব্যবস্থা করে দিয়ে যার কাছে যেমন পারছে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অক্সিজেনের ব্যবস্থা বা সেন্ট্রাল অক্সি-মিটারের ব্যবস্থা করে দিতে রোগী প্রতি ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন নামধারী এই সমস্ত স্বেচ্ছাসেবকরা। রোগীকে বাঁচাতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অক্সিজেন পেতে স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে গোপনে টাকা তুলে দিচ্ছেন স্বজনেরা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনা ইউনিটের রেড ও ইয়োলো জোনে রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই জোনে সবসময় ১৪০ থেকে ১৪৫ জন রোগী ভর্তি থাকছেই। বেশিরভাগ রোগীর শরীরে অক্সিজেনের পরিমান কম থাকায় তাঁদেরকে প্রতি মিনিটে ছয় থেকে ১০ লিটার অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। পূর্বে চুয়াডাঙ্গায় সদর হাসপাতালে প্রতিদিনে চাহিদা ছিল ১০০ থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত। কিন্তু এখন সেই চাহিদা প্রতিদিনে এক হাজার লিটারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
সদর হাসপাতালের ইয়োলো জোনে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘এখানে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট রয়েছে। একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার ১০ ঘণ্টাও চলে না। তার আগেই অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। আমার রোগীর তো অক্সিজেন প্রয়োজন, এক স্বেচ্ছাসেবককে ৫০০ টাকা দেওয়ার পর সে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’
টাকা দিয়ে অক্সিজেন পাওয়া অন্য আরেক রোগীর স্বজন বলেন, ‘গত রোববার আমার রোগীর শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ ৬০-এর নিচে নেমে যায়। যে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি চলছিল তা শেষ হয়ে গেলে অন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিতে বললে একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন সিলিন্ডার নেই। পরে অনেক আকুতি-মিনতি করেও কাজ হয়নি। তখন তাকে ৩০০ টাকা দিলে সে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে দেয়।’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে কিনা জানতে চাইলে এই রোগীর স্বজন আরও বলেন, ‘অভিযোগ করলে হয়তো টাকা দিয়েও আর অক্সিজেন পাবো না।’
সামগ্রীক বিষয় নিয়ে সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. এ এস এম ফাতেহ আকরামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এটা কতক্ষণ চলবে তা নির্ভর করে কতটা অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে তার উপর। একজন রোগীকে প্রতি মিনিটে কমপক্ষে তিন লিটার অক্সিজেন দিতে হয়। এ অবস্থায় একটি সিলিন্ডার মাত্র কয়েক ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, গণপূর্ত বিভাগের তৈরি সদর হাসপাতালের নতুন ভবনে মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইন থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। হাসপাতালে ১০৮টি সেন্ট্রাল অক্সিজের পোর্ট রয়েছে, গণপূর্ত বিভাগকে আরও পোর্ট বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়েছে। পূর্বে আমাদের ৫৩টি সেন্ট্রাল অক্সি-মিটার ছিলো। আর গত দুদিনে নতুন করে আরও ৬৫টি সেন্ট্রাল অক্সি-মিটার আমরা পেয়েছি। বর্তমানে করোনা ইউনিটে ৮টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিলিন্ডারটিতে প্রায় ৬ হাজার লিটার অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও হাসপাতালের সবগুলো সেন্ট্রাল অক্সিজেন পোর্ট ও ন্যাজাল ক্যানুলাতে একসাথে অক্সিজেন সরবরাহ করলে এই অক্সিজেন তিনদিনও চলবে না। এ অবস্থায় আমাদের ভেন্টিলেটর খুবই প্রয়োজন। ভেন্টিলেটরের বিষয়ে ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষকে জানানোও হয়েছে।’
করোনা ইউনিটের স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে অক্সিজেন দিয়ে রোগীর স্বজনদের নিকট থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে এ ধরণের কথা শোনা গেলেও রোগী ও স্বজনদের থেকে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপরও করোনা ইউনিটের দেওয়ালে স্বেচ্ছাসেবকদেরকে টাকা দিতে নিষেধ করে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকদেরকেও সতর্ক করা হয়েছে। তাছাড়া সেন্ট্রাল অক্সি-মিটারগুলো লাগানো হয়ে গেলে স্বেচ্ছাসেবকরা চাইলেও অক্সিজেনের জন্য আর টাকা নিতে পারবে না।
উল্লেখ্য, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল এলাকায় করোনা রোগীকে ঘিরে অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবসাও এখন তুঙ্গে। অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডার মালিক ও ড্রাইভারদের একটি সিন্ডিকেট করোনা রোগী বহনে তাদের কাছে ১২ কিলোমিটার রাস্তা রোগী পৌঁছাতে ১ হাজার টাকার ভাড়া ৫ থেকে ৬ হাজার ও ঢাকায় সাড়ে ১০ হাজার টাকার ভাড়া ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকা করে নিচ্ছেন। এই একই ভাড়ার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে ফ্রি অক্সিজেন সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতিটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য রোগীদের কাছ থেকে আলাদা করে আরও ১ থেকে দেড় হাজার টাকা অতিরিক্তি নেওয়া অভিযোগও এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।