উচ্চহারে ঘটছে খুনের ঘটনা: বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা দায়ী

দেশে উচ্চহারে খুনের ঘটনা ঘটছে। সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশ, গত মাসে ২৭৬ জন ও এর আগের মাসে দেশে ২৬৭ জন খুন হয়েছেন। বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও শত্রুতাবশত একে-অপরকে খুন করছে। বিশেষজ্ঞরা এসব হত্যার কিছু কারণ শনাক্ত করেছেন। তবে সেখানে মূল কারণটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে।

প্রতিটি সমাজে মানুষে মানুষে স্বার্থের দ্বন্দ্ব-শত্রুতা কমবেশি থাকে; কিন্তু শত শত মানুষের খুনের শিকার হওয়া বিরল। এটি শুধু হতে পারে যেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শিথিল সেসব দেশে। আমাদের দেশেও উচ্চহারে হত্যার ঘটনা আগে ছিল না। এমন নাজুক পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো; তা নিয়ে দেশে তেমন আলোচনা এখন নেই।

পত্রিকাটি লিখেছে, গত এপ্রিলে প্রতিদিন দেশে গড়ে ৯ দশমিক ২ জন খুন হয়েছেন। আগের মাসে সেটি কিছুটা কম ৮ দশমিক ৯ জন ছিল। এর আগের মাসগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান বের করলে উচ্চহারে খুনের ঘটনা পাওয়া যাবে। বিগত বছরগুলোতে প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে বীভৎস ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে তার বিস্তারিত উঠে এসেছে। খুনের চরিত্রও স্পষ্ট। এপ্রিলে খুনের ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৭ জন গুলিতে প্রাণ হারান। এ সময় ৭৭ জন গুলিবিদ্ধ হন। ব্যাপকভাবে ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীনদের একতরফা অবস্থান। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে বিপুল মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন এমন নয়। মূলত বিরোধীরা তাদের মোকাবেলায় মাঠে থাকবে ওই পরিস্থিতি নেই। তবে নির্বাচনী বিরোধে গত মাসে আটজনের প্রাণ গেছে। এগুলো মূলত ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরিণতি। তবে খুনের উচ্চহার বজায় থাকার মধ্যে রাজনৈতিক উপাদান বিদ্যমান।

একই পত্রিকা এক মাসে পারিবারিক সহিসংতায় ৬৫ জন খুন হওয়ার খবর দিয়েছে। এসব খুনের ঘটনার বিশ্লেষণে সাতটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- যৌতুক, মাদক কেনাবেচা, পারিবারিক বিরোধ, সম্পত্তির লোভ, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, সহিংস আচরণ ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আয়বৈষম্য। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নগরজীবনে মানুষের ব্যস্ততা, এককেন্দ্রিক স্বার্থপরতা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা আর গ্রামে সম্পত্তির বিরোধ থেকে খুনের ঘটনা ঘটছে বলে তারা জোর দিচ্ছেন। তারা পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে সহমর্মিতা ও ভালোবাসা দিয়ে পরিস্থিতি পরিবর্তনের কথা বলছেন। একটি স্বাভাবিক সমাজে সেটি হয়তো সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় যে পচন ধরেছে তার উৎপত্তি অনুসন্ধান করতে হবে। রোগের মূল কারণ শনাক্তের পর সে অনুযায়ী দাওয়াই দিতে হবে।

আমাদের সমাজে খুনের প্রবণতায় সামাজিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে; এর জন্য আমাদের দিশা হারানো রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা যে দায়ী; তার উল্লেখ নেই। খুনসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার জন্য দায়ী ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাওয়া বিচারব্যবস্থা। একটি সুস্থ সমাজে সবচেয়ে বড় অপরাধীর সবচেয়ে বড় বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। আমাদের সমাজে এখন অনেক ক্ষেত্রে তার বিপরীত অবস্থা বিরাজ করছে। লক্ষণীয়, যিনি যত অন্যায় করেন তিনি তত বেশি ক্ষমতাধর। সমাজে তার কদর বেশি। সবাই তাকে সমীহ করে।
এর কেন্দ্রে রয়েছে বিচারহীনতা। খুন-ধর্ষণ করে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। শুধু রাজনৈতিক সংযোগ থাকায় বিচারের বিবেচনা পাল্টে যাচ্ছে। কিংবা ক্ষমতার বলয় ব্যবহার করে অপরাধী শাস্তি এড়াচ্ছে। এ ধরনের সমাজে মানুষ উচ্চহারে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশি ব্যবস্থাও এতে অকার্যকর হয়ে পড়ে। পাকড়াও করার পর পুলিশ যখন দেখে অপরাধী উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে তার কদর বাড়ছে; তখন তাদেরও হতাশা গ্রাস করে। পরিস্থিতির কারণে ক্ষমতাধরদের পক্ষে অবস্থান নেয় পুলিশ। দেশে উচ্চহারে খুনের প্রবণতা রোধে বিচারব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হবে। এর আগে দরকার সুষ্ঠু গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, এতে ফিরে আসতে পারে সবার মধ্যে জবাবদিহি।