সমীকরণ প্রতিবেদন: ই-কমার্স এর নামে প্রতারণা থামছে না। ইভ্যালির প্রতারণার বিষয়টি চাউর হওয়ার পর একের পর এক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের টাকা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেয়ার অভিযোগ ওঠে। কেউ কেউ দিনের পর দিন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিসে ঘুরে কোনো পণ্য না পেয়ে দ্বারস্থ হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। পরে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী ও পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করেন মামলা। আইনের আওতায় আসেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তবে বসে নেই প্রতারক চক্রটি। তারা এখন ফেসবুক ভিত্তিক অনলাইন মার্কেটিং-এ ঝুঁকছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহককে পণ্য ডেলিভারি না দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলো তদন্ত করছে সিআইডি। পণ্য আত্মসাৎ করার অভিযোগে দেশের ৮টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ভুক্তভোগী এবং পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলাগুলো দায়ের করেছেন। এছাড়াও আরও ৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চলছে মামলার প্রস্তুতি।
যে ৮ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে ওই মামলাগুলোর তদন্ত চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এখন পর্যন্ত কোনো মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি মামলার তদন্তকারীরা। ওইসব প্রতিষ্ঠানের যারা কর্ণধার ও যে সব কর্মকর্তা নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেছে তাদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবার অনেকেই এখন পর্যন্ত রয়েছে পলাতক। এসব মামলার অধিকাংশই তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সিআইডি জানিয়েছে, তারা নিখুঁতভাবে মামলার তদন্ত অব্যাহত রেখেছেন। এখন পর্যন্ত ৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ৩টি’র বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা কীভাবে লেনদেন হয়েছে, পণ্য কীভাবে সরবরাহ করা হয়েছে, কেন সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি দেয়া হয়নি, অর্থ দেশে না বিদেশে পাচার হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কতো টাকা আছে তা নিয়ে চলছে তদন্ত। তদন্ত শেষে তারা মামলার চূড়ান্ত চার্জশিট দেবেন বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) মো. হুমায়ুন কবির জানান, ‘সিআইডিতে আসা ই-কমার্সের মামলাগুলোর তদন্ত চলমান রয়েছে। ৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সিআইডি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যদি পণ্য ডেলিভারির প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদেরও বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। এখন পর্যন্ত যে ৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ধামাকা শপিং ডট কম। ২০২১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর বনানী থানায় মামলাটি দায়ের হয়। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১১৬ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪৯৬ টাকার মানিলন্ডারিং এর অভিযোগ আনা হয়েছে। গত বছরের ৩০শে অক্টোবর গুলশান থানায় ই-অরেঞ্জ শপের বিরুদ্ধে এক ভুক্তভোগী মামলা দায়ের করেন। প্রতিষ্ঠানটি বিরুদ্ধে ২৩২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত বছরের ৩০শে সেপ্টেম্বর ২৪টিকিট নামে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলা দায়ের হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩২৪ টাকার ম্যানিলন্ডারিং এর অভিযোগ পেয়েছে সিআইডি। চলতি বছরের ২৩শে মার্চ সিরাজগঞ্জ সদর থানায় সিরাজগঞ্জ ডটকম নামে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহককে পণ্য না দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। পাশাপাশি ৪ কোটি ৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকার মানিলন্ডারিং এর অভিযোগ আনা হয়েছে। গত মার্চে গুলশান থানায় আনন্দের বাজারের নামে একটি মামলা দায়ের হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ টার মানিলণ্ডারিং এর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ২৬শে মার্চ শেরে-বাংলা নগর থানায় আকাশনীল কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয় এবং প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ টাকার মানিলন্ডারিং এর অভিযোগ এসেছে।
সূত্র জানায়, গত ৪ঠা আগস্ট রিং আইডি বিডি লিমিটেডের নামে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ম্যানিলন্ডারিং এর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৪ঠা আগস্ট বনানী থানায় আলিফ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয় এবং ওই মামলায় ৭৮ লাখ টাকার প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়াও দালাল প্লাস, থলে ডটকম এবং এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপেস নামে ৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই ৩ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের ৪৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, এ ছাড়াও মনোহর, পিকাবু, পাবজি, আলাদীনের প্রদীপ, মীনা ক্লিক, বাবুই, ব্যাকপ্যাক, আলি টু বিডি, সেল মার্ট, গ্যাজেট মার্ট, বিডিটিকেটস, সাবু শপ, আমারি, শপ আপ, কমপ্লেক্স ডটকম, রাজারহাট, বিডিশপ, চাহিদা ইশপ, বুমবুম, ইভ্যালি, দারাজ, সহজ, আজকের ডিল, ফুডপান্ডা, চালডাল, প্রিয়শপ, বিক্রয় ডটকম, নিরাপদ, রকমারি ও আদিয়ান মার্ট ডটকমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলামান আছে। সূত্র জানায়, যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করেছে তার কিছু তথ্য তারা পেয়েছেন। সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে এটা তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকা সরানো হয়েছে। ওই টাকা কারও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে বা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।