ইভিএম ইতিবৃত্ত
- আপলোড টাইম : ০৮:৪৭:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮
- / ৭৯৩ বার পড়া হয়েছে
-হারুন-উর-রশিদ
দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বচন দরজায় কড়া নাড়ছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে নির্বাচন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন করতে হবে। বিএনপি এবারও নির্বাচনে না এলে কী হবে? তা নিয়ে হয়তো হাজারো প্রশ্নের অবকাশ থাকবে। তবে নির্বাচন যে হবে, তা বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অদ্ভুত বিরোধী দলের নেতা দিল্লি সফর শেষে দেশে ফিরে জানিয়েছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে তারা ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেবে। এ থেকে মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়, বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রের সম্মতি আছে। আর এখন আমাদের দেশের উপর ভারতের প্রভাব উপলদ্ধি করার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
আর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে এখন সবচেয়ে বড় আলোচ্য ইস্যু হলো- জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একশটি আসনে ইভিএম মেশিনের মাধ্যমে ভোট গ্রহন। এ নিয়ে দেশের সবখানে চলছে তুমুল আলোচনা। সরকারি দল বলছে, তারা ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার ও প্রযুক্তিবান্ধব সরকার তাই নির্বাচনে তারা ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। অপরপক্ষে বিরোধীপক্ষের অভিযোগ, ইভিএম মেশিন দ্বারা ভোট চুরি নয় ভোট ডাকাতি সম্ভব, সরকার ‘মেশিনে ভর’ করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। আসলে কী এই ইভিএম মেশিন? আসুন জেনে নেয়া যাক-
মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ইলেকট্রনিক ভোটিং আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট প্রয়োগ বা সংশ্লিষ্ট ভোটারদের স্বীয় মতামত প্রতিফলনের অন্যতম মাধ্যম। ভোট প্রয়োগে মেশিন বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি অণুসৃত হয় বিধায় সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নামে পরিচিত। এর অন্য নাম ই- ভোটিং।
১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে সর্বপ্রথম ভোট গ্রহণে ইভিএম পদ্ধতির প্রয়োগ হয় বিশ্বে। এরপর থেকে বিশ্বের নানা দেশে ইভিএম এর মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। আমাদের দেশে ভোট গ্রহণে ইভিএম প্রথমবার ব্যবহার করা হয় ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। এরপর ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরে নরসিংদী পৌরসভা ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়। গতবছর রংপুর, এবছর খুলনা , গাজীপুর, ররিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সল্পপরিসরে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে।
বিশ্বে এখন পর্যন্ত যেসব দেশ ইভিএম ব্যবহার করেছে সেগুলো হলো-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, পেরু, রোমানিয়া, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইন, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, স্পেন, সুইডেন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশকিছু দেশে এই ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
আমাদের দেশে আমরা কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ দেই । ভারত ১৯৭৭ সালে প্রথম ইভিএম চালু করে। ১৯৯৮ সালে দেশটিতে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতি দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ইসি লোকসভার ৫৪৩ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন করে ২০০৪ সালে। এক্ষেত্রে ভারত ইভিএম প্রযোগ করার জন্য সময় নিয়েছে ২২ বছর। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হওয়ার পর ইসি সময় নিয়েছে ৬ বছর।
আর আমাদের দেশে, গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে ইসির সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ৭ টি দলের দবি ছিল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের। বিপরিতে বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। স্পস্টত বলা যায়, এ বিষয়ে এখনও দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এরমধ্যে কমিশন দেড় লাখ ইভিএম কেনার অনুমোদন দিয়েছে । বিয়ষটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ( সিইসি) কে এম নুরুল হুদা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এর জন্য ব্যয় হবে ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে এই ইভিএম কেনা হবে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো ইভিএমে কি আসলেই ভোট কারচুপির সুয়োগ আছে? যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রায় হ্যাকিং করে পাল্টে দেওয়া হয়েছিল বলে ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় । রাশিয়ার হ্যাকাররা নাকি চীনা হ্যাকাররা একাজ করেছে এ নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। ২০০০ সালের মার্কিন নির্বাচনে বিতর্কিত ভোট গনণা ও বুশের কাছে আল গোরের হেরে যাওয়ার ঘটনাকেও আমরা স্মরণ করতে পারি। নির্বাচনে হার মেনে নিয়ে আল গোর বলেছিলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রের শক্তি ও গণঐক্যের স্বার্থে আমি রায়টা মানছি মাত্র।’ তবে তিনি সব ভেট হাতে গণনার দাবি করেছিলেন।
ভারত বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ও তাদের আছে মেরুদন্ডসহ ইসি। সেখানেও ইভিএম নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। বহুজন সমাজ পার্টির প্রধান মায়াবতী, দিল্লির মূখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, দিল্লির কংগ্রেস নেতা অজয় মাকেন অভিযোগ করেছেন ইভিএম-এ কারচুপি সম্ভব। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলন করে মায়াবতী অভিযোগ করে বলেন, ‘ইভিএম যন্ত্রগুলিতে বড় ধরণের কারচুপি করা হয়েছে, যার ফলে শুধু বিজিপি’র দিকেই ভোট চলে গেছে।’ ভারতে এখন কংগ্রেসসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দাবি জানাচ্ছে, ইভিএম’র আর দরকার নেই। ভারতে আবার কাগজের ব্যালেটের মাধ্যমে ভোট নেওয়া হোক।
জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করেছে। আর আমরা কোনরকম দীর্ঘমেয়াদী পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই জাতীয় নির্বাচনের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বচনে ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছি। যদিও এখনও এখানে অনেকগুলি যদি আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ( সিইসি ) কে এম নুরুল হদার মতে,‘আইনের সংশোধনী পাস হলে এবং সবার সমর্থন পেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দৈবচয়নের ভিত্তিতে কিছু আসনে ইভিএম ব্যবহারের চেষ্টা করবেন তারা।’ তাহলে শেষ সময়ে এসে কেন কমিশন ইভিএম বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
নেপালে বিমসটেক সম্মেলনে যোগদান শেষে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচন হবে কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিছুটা সংশয় থাকলেও দেশের মানুষও অধীর আগ্রহে বসে আছে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নিজেদের মতোকরে কৌশল সাজাচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার আশায়। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সহায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা সেটা ভবিষ্যত বলবে। তবে তাদের সামনে অন্যকোন বিকল্প আছে বলে আমার জানা নেই। যদি যেকোন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও তার শরিকরা নির্বাচনে আসে, তাহলে তা হবে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক। নির্বাচনের আর খুববেশি দিন বাকী নেই। এমন পরিস্থিতিতে নির্বচন কমিশনের শক্তিশালী ভূমিকা দেশবাসী আশাকরে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের মতো অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি না করে ইসির উচিত আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কিভাবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করা যায় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। সরকারের ইচ্ছাপূরণের দিকে অধিক মনযোগী না হয়ে ইসি দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করুক এটাই সকলের প্রত্যাশা।