সমীকরণ প্রতিবেদন:
বহুল আলোচিত স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান হত্যার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান সম্পর্কে একের পর এক বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি তার সিন্ডিকেটের যে দুজনকে দিয়ে আবু ইউসুফ লিমনকে ভুয়া আসামি সাজিয়েছিলেন, তারা কোথায়? এ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে নতুন করে। ওই দুজন হলেন- নারায়ণগঞ্জের জোবায়ের আহমেদ বাপ্পী ও নোয়াখালীর ফরহাদ আহমেদ মজুমদার। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতারণার মামলা করেছেন লিমনের বাবা নুরুজ্জামান। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘেঁটে জানা যায়, জোবায়ের আহমেদ বাপ্পীও এখন অবস্থান করছেন দুবাইয়ে। কিন্তু ফরহাদের খোঁজ কেউই জানাতে পারেননি। এদিকে আরাভ ওরফে রবিউলের পরিবর্তে জেলখাটা লিমন রাজধানীতে রাইড শেয়ারে বাইক চালান। একই সঙ্গে ক্রিকেটের প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন। লিমনের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুরের ৬ নম্বর বাজারে উঠতি ক্রিকেট প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিতেন লিমন। সেখানে ক্রিকেট প্রশিক্ষণার্থীরা যে বাসায় থাকতেন, সেখানে একজন দুবাইয়ের লাগেজ ব্যবসায়ীও থাকতেন। ওই সূত্রে আরাভ ওরফে রবিউল ইসলামের সঙ্গে উঠতি ক্রিকেট প্রশিক্ষণার্থীদের যোগাযোগ তৈরি হয়। আবু ইউসুফ লিমন জানান, প্রতারণার শিকার হয়ে তিনি মামলার আসামি হয়েছেন। নিরপরাধ হয়েও তিনি জেল খেটেছেন। আর এখন প্রতারণার মামলার হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ৯ মাস জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পান লিমন। হাই কোর্ট থেকে লিমনের এই জামিন করিয়ে দিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট শামীম সরকার। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি শুধু জামিন করিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর মামলাটি জজ কোর্টে চলে যায়। এ ছাড়া বিস্তারিত আমার কিছু জানা নেই।’ গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন লিমনের বাবা নুরুজ্জামান। তিনি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় পরিবার পরিকল্পনা অফিসে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘লিমন ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করে। এরপর তাকে কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ার ম্যাটসে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্সে ভর্তি করে দিই। তিন বছর পড়ার পর সে চূড়ান্ত পরীক্ষা না দিয়ে ক্রিকেট খেলতে ঢাকায় চলে যায়। সে ক্রিকেটের জন্য খুব পাগল ছিল। এ নিয়ে আমার সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়। আমি তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই। তবে বাড়িতে তার মা-বোনদের সঙ্গে কথা বলত। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আরাভ ওরফে রবিউলের সঙ্গে লিমনের পরিচয় হয়। পরে সরাসরি পরিচয় হয় জোবায়ের আহমেদ বাপ্পী ও ফরহাদ আহমেদ মজুমদারের সঙ্গে। তারাই আরাভ ওরফে রবিউলের হয়ে লিমনের সঙ্গে যোগাযোগ করত। তাকে বিকেএসপিতে খেলার সুযোগ করে দেবে বলে লিমনের আইডি কার্ড-সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র নেয়। লিমন প্রলোভনে পড়ে জেলে গেলেও পরিবারের কাছে বিষয়টি গোপন রাখে। তিন মাস জেলে থাকার পর তার বিষয়টি আমরা জানতে পারি। এরপর তার জামিন পেতে আরও ছয় মাস লেগেছে। এই মামলায় ছেলেকে জামিনে আনতে গিয়ে অনেক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সব মিলিয়ে আমার প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’ স্বজনরা বলছেন, করোনাকালে আরাভের সঙ্গে ফেসবুকে লিমনের কথা হয়। আরাভ জানান, তিনি আমেরিকায় থাকেন, দেশে এলে লিমনকে বিকেএসপিতে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেবেন; একটা ভালো দলে খেলার পাশাপাশি সাকিব আল হাসানের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দেবেন; কিন্তু মামলার কারণে তিনি দেশে আসতে পারছেন না। লিমনকে আরাভ অনুরোধ করেন, তার হয়ে আদালতে গিয়ে কাস্টডিতে গেলে তিনি তাকে দেড় মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত করবেন। এতে লিমনকে ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। একসময় লিমন তার প্রস্তাবে রাজি হয়। ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর আরাভের কথামতো লিমন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যান। এর পরদিন রবিউল ইসলাম পরিচয়ে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। জেলে যাওয়ার পর একাধিকবার লিমনের জামিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ সময় আরাভ ওরফে রবিউল আশ্বস্ত করেন, ১৬ ডিসেম্বরের আগেই জামিনের ব্যবস্থা করবেন। এরপর ডিসেম্বরেও তিনি জামিন করাতে ব্যর্থ হন। লিমনকে তখন কাশিমপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে এই মামলার অন্য আসামিদের সঙ্গে কথা হয়। লিমনের বাবা নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা তিন মাস ধরে লিমনের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। পরে থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। লিমনের কয়েকজন বন্ধু তাদের ফেসবুকে তার ছবিসহ পোস্ট করে স্ট্যাটাস দেয় যে, আবু ইউসুফ লিমনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার মা-বাবা খুব টেনশন করছেন। ওই পোস্ট দেখে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ইমোতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বলে, সে নাকি সাভারের বিকেএসপিতে লিমনকে ভর্তি করে দিয়েছে। সে খেলা নিয়ে ব্যস্ত, তাই ফোন করতে পারছে না। হঠাৎ ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি লিমন জেল থেকে তার ছোট বোন লিজাকে ফোন করে বলে যে, খুনের মামলায় আসামি হয়ে সে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছে।’ ২০১৮ সালের ৮ জুলাই খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খান (৩৪)। এ ঘটনায় ওই বছরের ১০ জুলাই মামুনের ভাই রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এরপর ঢাকার ১ নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু হয় মামলাটির। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়েছে। এই মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়। তিনি পলাতক হয়ে দুবাইয়ে আরাভ খান নামে ব্যবসা করছেন।