
সমীকরণ প্রতিবেদন:
পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪৪ জন। আহত হয়েছেন ১৫০ জনের বেশি। এর মধ্যে ৩০ জনের অবস্থা গুরুতর। ফলে নিহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মসজিদটি পেশোয়ারের পুলিশ লাইনস এলাকার ভেতর। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার জোহরের নামাজ আদায় করার সময় মসজিদের সামনের সারিতে উপস্থিত ছিল আত্মঘাতী হামলাকারী। নামাজের মধ্যেই সে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে মুসলিস্নদের রক্তে ভেসে যায় ওই মসজিদ। তাদের আর্তচিৎকারে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। এ ঘটনার পর ওই শহরে মেডিকেল জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে প্রাদেশিক স্বাস্থ্য বিভাগ। হামলার দায় স্বীকার করেছে দেশটির নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। এই সংগঠনটি ‘পাকিস্তানি তালেবান’ নামেও পরিচিত। সংবাদসূত্র : বিবিসি, আল-জাজিরা, ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন
বিস্ফোরণে হতাহতের তথ্য নিশ্চিত করে পেশোয়ারের কমিশনার রিয়াজ মেহসুদ বলেন, মসজিদের ভেতর উদ্ধার অভিযান চলছে।। অনেকেই মসজিদের ধ্বংস্তূপের নিচে আটকে পড়ায় হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি। এই হামলায় নিহতদের বেশিরভাগই পাকিস্তানের পুলিশের কর্মকর্তা। তবে বোমা হামলাকারী কীভাবে প্রাচীরঘেরা মসজিদের ভেতর ঢুকে পড়েছিল, সেটা স্পষ্ট নয়। একজন দাবি করেছেন, দুটি পুলিশ চেকপোস্ট পেরিয়ে মসজিদে যেতে সক্ষম হয় হামলাকারী। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেছেন, জোহরের নামাজের সময় পুলিশ লাইন্স এলাকার মসজিদের সামনের সারিতে উপস্থিত ছিল আত্মঘাতী হামলাকারী। একপর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেয় সে। যে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখানে পেশোয়ার পুলিশ, সিটিডি, এফআরপি, এলিট ফোর্স এবং টেলিযোগাযোগ বিভাগের সদর দপ্তর রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যম বলছে, স্থানীয় সময় সোমবার দুপুর ১-৪০ মিনিটে পেশোয়ারের পুলিশ লাইন্স এলাকার ওই মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। সাধারণত ৪০০-৫০০ মুসলিস্নর ধারণক্ষমতা-সম্পন্ন ওই মসজিদে জোহরের নামাজের সময় ২০০ জনের বেশি মুসলিস্ন উপস্থিত ছিলেন। শক্তিশালী বিস্ফোরণের ধাক্কায় মসজিদ ভবনের একাংশের দেয়াল ধসে গেছে এবং নামাজের জামাতে যারা সামনের সারিতে ছিলেন, তাদের অনেকেই ধ্বংস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন। বিস্ফোরণের পরপরই ধ্বংসস্তূপে আটকেপড়াদের উদ্ধারে পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং বোমা নিষ্ক্রিয়করণ স্কোয়াডের সদস্যরা কাজ শুরু করে দেন। পাশাপাশি উদ্ধার তৎপরতা চালান সাধারণ লোকজনও।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি মসজিদে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ ছিল। বিস্ফোরণের পর সর্বত্র ধোঁয়া উড়ছিল। এই প্রত্যক্ষদর্শী আরও বলেন, মসজিদের ভেতর ২০০ জনের বেশি মানুষ নামাজ আদায়ের সময় বিস্ফোরণটি ঘটেছে। এটা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ। কারণ, বোমা হামলাকারী মসজিদের ভেতর ছিল। নামাজ শুরু হওয়া মাত্রই বিস্ফোরণটি ঘটেছে। হতাহতদের মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশ সদস্য বলে জানিয়েছেন তিনি। মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন সিভিল সেক্রেটারিয়েট অ্যাসোসিয়েশন পেশোয়ারের সভাপতি তাসাভুর ইকবাল। তিনি বলেন, পুলিশ লাইন্স এলাকায় সবসময় সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরিচয়পত্র এবং দেহ তলস্নাশি ছাড়া কেউই এই মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না। এরপর কীভাবে হামলাকারী মসজিদে প্রবেশ করতে পেরেছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পেশোয়ারের এই বাসিন্দা বলেন, ‘আজকের (সোমবার) এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা অনেক বড় মসজিদ। একসঙ্গে ৪০০-৫০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। বিস্ফোরণে ভবনের একাংশ ধসে গেছে। তবে বোমাটি আগে থেকেই মসজিদে পেতে রাখা হয়েছিল, নাকি এটি আত্মঘাতী হামলা- সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন দেশটির পুলিশ কর্মকর্তারা। বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থলের আশপাশের সব সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইসলামাবাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, মসজিদে বিস্ফোরণের এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, মসজিদের ভেতর বিস্ফোরণ প্রমাণ করে, হামলায় জড়িতদের ‘ইসলামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।’ মসজিদে হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করে তিনি বলেছেন, ‘এই সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালনকারীদের লক্ষ্য করে ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে।’ দেশটির বিরোধী-দলীয় নেতা ইমরান খান এক টুইট বার্তায় এ ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদী আত্মঘাতী হামলা’ উলেস্নখ করে নিন্দা জানিয়েছেন। হতাহতদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন তিনি। ইমরান লেখেন, ‘সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলায় আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীকে আরও উন্নততর প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।’ উলেস্নখ্য, গত বছর পেশোয়ারের একটি মসজিদে প্রায় একই ধরনের একটি হামলার ঘটনা ঘটেছিল। শহরটির কোচা রিসালদার এলাকার এক শিয়া মসজিদে নামাজ চলাকালীন আত্মঘাতী সেই বোমা হামলার ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৩ জন।
ভাইয়ের হত্যার বদলা নিতেই মসজিদে হামলা: টিটিপি
এদিকে, পেশোয়ারের মসজিদে হামলার দায় স্বীকার করেছে দেশটির নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। মসজিদে হামলার পরপরই নিষিদ্ধ ওই সংগঠন দায় স্বীকার করে। নিজ ভাইকে হত্যার প্রতিশোধ নিতেই প্রাণঘাতী এই হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন তালেবানের কমান্ডার সারবাকাফ মোহমান্দ। গত বছর দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত অস্ত্রবিরতি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানজুড়ে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছিল টিটিপি। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের স্থাপনা লক্ষ্য করে টিটিপি যে হামলা চালিয়ে আসছে, এর মধ্যে পেশোয়ার মসজিদে হামলার এ ঘটনা সবচেয়ে বড়। পাকিস্তানি তালেবানের কমান্ডার সারবাকাফ মোহমান্দ টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় পেশোয়ার মসজিদে হামলার দায় স্বীকার করেছেন। তবে এই হামলার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে জঙ্গি গোষ্ঠীটির প্রধান মুখপাত্রের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। দেশটির গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত টিটিপি কমান্ডার উমর খালিদ খুরাসানির ভাই মোহমান্দ। গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে নিহত হন উমর খালিদ। ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই পেশোয়ারের মসজিদে আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন তালেবানের কমান্ডার মোহমান্দ।