
প্রতি বছর কত সংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের অসম্পূর্ণ হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে সর্বশেষ ২০২১ সালে আত্মহননের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হওয়ার কথা। সহযোগী একটি দৈনিক খবর দিয়েছে, রাজধানীতে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় এবং তার পরে ছাত্ররা কেন আত্মহত্যা বেশি করছে এ নিয়ে গবেষণা হয়নি। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু সংবাদ প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, হতাশা ও বিদ্রƒপের শিকার হয়ে জীবনকে শেষ করে দেয়ার পথে হাঁটছে অনেকে।
গত বছর বিবিসি বাংলা এ সংক্রান্ত এক নিন্মবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত নারীর আত্মহত্যার চেষ্টার কাহিনী তুলে ধরে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ন্নাতক শেষ করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ পরীক্ষা অংশ নিতে থাকেন। তিনবার বিসিএস পরীক্ষায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, তার পরও অন্যান্য নিয়োগে অংশ নিয়ে সফল হতে পারেননি। এদিকে দরিদ্র মা-বাবা সংসারের হাল ধরার জন্য তার অপেক্ষা করছিলেন। অবশেষে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। পরিবারের লোকেরা তাকে কটু কথা শোনাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তবে বিবিসির ওই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ জন শিক্ষার্থী নিজের হাতে নিজের জীবন দিয়েছেন।
বিবিসি একই প্রতিবেদনে আরেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের কথা উল্লেখ করে। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় কতটা অসুস্থতা ও রোগ রয়েছে ঘটনাটি তার প্রমাণ। ওই ছাত্র গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে। তিনি ছোটখাটো গড়নের ও আঞ্চলিক টোনে কথা বলতেন। এ জন্য বন্ধুরা তাকে ঠাট্ট-তামাশা করত। শারীরিক গঠন, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি ও পোশাক নিয়েও মশকরা করত। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তার শিক্ষকও এতে যুক্ত হয়েছে। সহ্য করতে না পেরে তিনি ভাড়া বাসার পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করতে যান। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন।
সম্প্রতি ঢাকায় শিক্ষার্থীদের উপর্যুপরি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে এর কারণ বেকারত্ব ঘোচাতে না পারা। কিংবা অনেকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পেয়ে এ পথে পা বাড়ান। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৬ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার উচ্চহার দেখা যাচ্ছে। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এগুলোর সাথে কিছু ক্ষেত্রে বঞ্চনা কারণ হিসেবে কাজ করলেও বয়সজনিত ব্যাপারটি রয়েছে। সাধারণত ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে উচ্চ আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও টিজিংয়ের ব্যাপারটি গুরুতর উপাদান হিসেবে দেখা যায়। এ বয়সী মেয়েদের অপমান করার একটি বিষয় রয়েছে। কাউকে কালো বলা কিংবা তার প্রাইভেট বিষয়ে অনাহূত আঘাত করার ফলে সেটি হতে পারে। স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী ৬০ শতাংশের বেশি নারী।
১০ সহস্রাধিক মানুষ গড়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেও তাদের নিবৃত্ত করার উদ্যোগ সেভাবে নেই। আত্মহত্যার পেছনে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ জড়িত। সেগুলো চিহ্নিত করাও কঠিন কিছু নয়। মানুষের আত্মহত্যাপ্রবণতা সারা দেশে রোধ করার বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা না গেলেও অন্তত শিক্ষার্থীদের
আত্মহত্যাপ্রবণতা ঠেকাতে কাজ করা যায়। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অভাববোধ ও বঞ্চনা থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহনন ঠেকাতে হলে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। তবে আচরণে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা টিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করবেন, এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও শিক্ষকরা যদি সঠিক আচরণ করতে না পারেন তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? আমরা আসলে কোন ধরনের শিক্ষা নিচ্ছি প্রতিষ্ঠান থেকে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।