আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা;
সামাজিক অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ

সম্পাদকীয়


সম্প্রতি আমরা সামাজিকভাবে চরম অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি। এর আলামত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে শাসকশ্রেণীর মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মারার মতো নিষ্ঠুর ঘটনাও গত বছর তিনেক আগে বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে বেশ কিছু নির্দোষ মানুষ প্রাণ হারান। এ দায় রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ, প্রত্যেক নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য একটি কাজ। তবে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই যে, এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে তা না বলাই ভালো। আইনের প্রতি আমাদের অশ্রদ্ধাও এর জন্য কম দায়ী নয়। বাস্তবতা হলো- দেশে সমাজে জেঁকে বসেছে দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গত কয়েক দিনে এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যার কারণে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমাদের এসব ঘটনা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এমন কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরলে সামাজিক অসহিষ্ণুতার প্রমাণ মিলবে। যেমন- প্রথম যে ঘটনাটি তুলে ধরতে চাই, তা সঙ্ঘটিত হয়েছে নোয়াখালীর হাতিয়ায়। ওই এলাকায় এক স্কুলছাত্রী ও তার মাকে (৩৮) পিলারে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের ভিডিও করে ছেড়ে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যা এর মধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, জমি নিয়ে বিরোধে প্রতিপক্ষ এই নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটিয়েছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় দশম শ্রেণী পড়ুয়া কিশোরীকে প্রতিপক্ষ এলোপাতাড়ি মারধর করে। মেয়ের চিৎকারে মা এগিয়ে এলে তিনিও মারধরের শিকার হন। একপর্যায়ে দু’জনকে ধরে নিয়ে একটি পিলারে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফের নির্যাতন করা হয়। শুধু তাই নয়, বেঁধে রাখার ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে পরবর্তীতে টিকটক বানিয়ে আপলোড করলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা রীতিমতো ভাইরাল হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। গাছের সাথে বেঁধে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তার জায়গায় নির্মিত পাকা দেয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জায়গা জবরদখল করতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের মন্দাকিনী গ্রামে ওই ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানাজানি হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। তৃতীয় ঘটনার অবতারণা ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায়। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার রানাপাশা ইউনিয়নের তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামে। চুরির অভিযোগে এক শিশু ও তার বাবাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ১১ ঘণ্টা আটকে রেখে মারধর করা হয়। শিকল দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। পিটুনি থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে গেলে তার বাবা মারধরের শিকার হন। ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে স্থানীয়ভাবে মুচলেকা নিয়ে বাবা-ছেলের মুক্তি মেলে। উপরিউক্ত ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে পরস্পর এক সাথে করে অবলোকন করলে আমরা দেখতে পাবো, প্রতিটি ঘটনায় সমাজের সবল ব্যক্তিরাই দুর্বলের ওপর চড়াও হয়েছেন। অথচ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। এটিই বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোতে নাগরিকের কাছ থেকে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের চুক্তি। কিন্তু আমাদের দেশে সেই আদর্শ অবস্থা খুবই দুর্বল। গত দেড় যুগে তা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ফলে সমাজে এই অসহিষ্ণুতার জন্ম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতো আমরাও মনে করি, বর্তমান সামাজিক এ ভাঙন ঠেকাতে হলে নাগরিকদের যেমন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রকে প্রত্যেক নাগরিকের আইনগত অধিকার সুরক্ষা দিতে হবে। একই সাথে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। তবেই সামাজিক এই চরম অসহিষ্ণুতা থেকে আমাদের মুক্তি মিলতে পারে।