সাজ্জাদ হোসেন : চুয়াডাঙ্গা জেলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হিসেবে দর্শনার ‘অনির্বাণ থিয়েটার’ এর ভূমিকা এ অঞ্চলে সমাদৃত। গ্র“প থিয়েটার ধারনার প্রবর্তক অনির্বাণ এর নির্দেশিত পথ ধরেই এ জেলার সাংস্কৃতিক চর্চা এক সদর্থক গতি অর্জন করে। বর্তমানে ‘চুয়াডাঙ্গা’ সমগ্র বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক বান্ধব জেলা হিসেবে পরিচিত। আর ‘অনির্বাণ’ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ মর্যাদার আসনে সমাসীন। অনির্বাণ আজ চুয়াডাঙ্গার গর্ব, অনির্বাণ আজ চুয়াডাঙ্গাবাসীর অহংকার। ‘জাতীয় সংস্কৃতিক প্রগতিশীল বিকাশ চাই’ এই মূলমন্ত্রে ১৯৮৩ সালের ১৭ ফেব্র“য়ারি শিল্পিত সামিয়ানার নীচে অনির্বাণ-এর জন্ম। দেশে তখন শ্বৈরাচার সরকারের নির্লজ্জ অহংকার গণতন্ত্রকে উপহাস করছে। যারা প্রতিষ্ঠাতা তারা প্রায় সকলেই একটি বাম রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ও এদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্মুখ সমরের বীর সেনানি। তাদের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক আদর্শিক ফসল ‘অনির্বাণ’। অনির্বাণ তার নামের মত প্রদীপ্তমান শিল্প-সংস্কৃতির আঙিনায়। শুরু থেকেই অনির্বাণ শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা : নাটক, নৃত্য, সংগীত, সাহিত্য, আবৃত্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর রেখেছে। অনির্বাণের নানামুখি বহুবর্ণিল সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় মানুষকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছে। তেমনি এদেশের সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও মানবিক আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উলে¬খযোগ্য ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। অনির্বাণের এই যাত্রাপথে সমসময়ই অসুন্দরেরা বেঁধেছে বাঁধ। শ্বৈরাচার সরকার যেমন বন্ধ করেছে নাটকের মহড়া, ঠিক তেমনি গণতান্ত্রিক সরকারও গুড়িয়ে দিয়েছে নাটকের স্থায়ী মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধের চিত্র প্রদর্শনী ও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালা। প্রতিবাদে পথে হাটে মাঠে ঘাটে কালো ব্যাজ ধারণ করেছে অনির্বাণ কর্মীরা। পাল্টা হুমকি ধামকি এসেছে বুকের মাংশ তুলে নেবার। তবুও থামেনি আন্দোলন। পাল্টে যায়নি প্রতিবাদের ভাষা। পথচলা।
অনির্বাণ তার লক্ষ্যে অবিচল। এই দেশ, এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধারণের মধ্যদিয়ে একটি চিরমূখীন ঋদ্ধ সমাজ নির্মাণে। অনির্বাণের পরিচিতি প্রধানত অভিনয় নৈপুণ্যেভরা আধুনিক নাটক নির্মাণের কারণে। জন্মলগ্ন থেকেই অনির্বাণ দেশ, সমাজ, রাষ্ট্রের ক্ষমতা-কর্তৃত্বের ক্রম বর্বরায়নের বিরুদ্ধতা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে চলমান সমাজের ন্যায়-অন্যায়, সঙ্গতি-অসঙ্গতি, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, প্রভৃতি বিষয়ে নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে দর্শকের সাথে সরাসরি একটা সেতুবন্ধন গড়ে তোলে। তাদের প্রথম স্বার্থক রূপায়ন মুনীর চৌধুরীর অবস্বরণীয় নাটক ‘কবর’। অনির্বাণ এ পর্যন্ত ৪২ টি নাটক প্রযোজনা করেছে। নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে কবর, সিংহাসন, রথযাত্রা, অভিযান, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এদেশেও নর্ম্যান বেথুন, ওরা আছে বলেই, ইলেকশান ক্যারিকেচার, একটি আত্মনির্ভর যুদ্ধের জন্য এবং লাঠিয়াল, এখন দুঃসময়, কুম্ভকর্ণের ঘুম, কিংশুক যে মেরুতে, ওরা কদম আলী, এখানে নোঙর, আদম আলীর দিনরাত্রী, ফেরারী নিশান, স্বাধীনতার ময়না তদন্ত, বিবিসাব, অতিথি ও ভদ্দরলোক, তোমরাই, রাঘব মালাকার, ইবলিশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, চাঁন মিয়ার বায়োস্কপ, রিসার্চ, বন্যা, এবার ধরা দাও, এখানে এখনও, আড়ষ্ট জন্মভূমি, আজও আদিম, মান্যবর ভূল করছেন, মৃত্যুঞ্জয়ী, পকেটমারের পাঁচালী, অসমাপ্ত সংলাপ, বিরসা মুন্ডার গান, বড়াই লড়াই, মানব, মুচিরাম গুড়, বীজ, সুরত ও জিষ্ণু যারা। এসব নাটকে দলীয় নির্দেশক হিসাবে কাজ করেছেন রবিউল আলম বাবু, মোবারক হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, সোনা মিয়া, আব্দুস সামাদ, গোলাম ফারুক আরিফ, মহসীন আলী, আনোয়ার হেসেন, আ.সা.আজাদ বিপু, সাজ্জাদ হোসেন এবং হাসমত কবির। অতিথি নির্দেশক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন দেশবরণ্য নাট্যজন সৈয়দ জামিল আহম্মেদ, কামাল উদ্দিন নীলু, কামরুজ্জামান রুনু ও ভারতের প্রখ্যাত নাট্যগুরু প্রবীর গুহ। যিনি নাট্যশিল্পে পৃথক একধারা সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বনাট্যাঙ্গনে নিজেকে দাড় করিয়েছেন অনন্য এক উচ্চতায়।
অনির্বাণ তাদের প্রযোজিত নাটকগুলি একদিকে যেমন দর্শনায় মঞ্চস্থ করেছে। অন্যদিকে ঢাকা, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, গাংনী, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গা, জীবননগর, গয়েশপুর, দামুড়হুদা, কার্পাসডাঙ্গা ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রদর্শনী করেছে। অংশগ্রহণ করেছে জাতীয় নাট্য উৎসব, জাতীয় পথনাটক উৎসব, আঞ্চলিক নাট্য উৎসবসহ বিভিন্ন পালা-পার্বণে। অনির্বাণের উলে¬খযোগ্য আয়োজনের মধ্যে রয়েছে দর্শনা যুব উৎসব, অনির্বাণ উৎসব, নাট্য উৎসব, পথনাটক উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, গুণীজন সম্মাননা, মেলা, বাংলা বর্ষবরণ উৎসব ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এসব আয়োজনে বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ফোকালার উপাদান সমূহ পরিবেশিত হয়েছে। এছাড়াও আমাদের সংস্কৃতির প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক প্রাচীন ঐতিহ্য যাত্রার নান্দনিকতা (বর্তমানে সাধারণভাবে প্রচলিত যৌন-অশ¬ীনতার অর্থে নয়) ফিরে পেতে বেশ কয়েকবার আয়োজন করেছে ‘যাত্রা উৎসব’। অনির্বাণ কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গতদের সাহায্যর্থেও তাদের হাত প্রসারিত করেছে মানবিক টানে।
বাংলাদেশ গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশান সদস্য অনির্বাণ আরো একটি দায়িত্ব পালন করে, তা হলো বিভিন্ন সংগঠনের নাট্যকর্মীদের মধ্যে আত্মঃসম্পর্ক গড়ে তোলা। তারই ধারাবাহিকতায় অনির্বাণের আয়োজনে দর্শনায় দুইবার অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশান ‘খুলনা বিভাগীয় সম্মেলন’। তাছাড়া অনির্বাণের আমন্ত্রণে ঢাকার নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক নাট্যদল, ঢাকা পদাতিক, লোক নাট্যদল, নাট্যচক্র, নন্দন, সুবচন নাট্য সংসদ, সংলাপ গ্র“প থিয়েটার, ইউনির্ভাসেল থিয়েটার, বটতলা, ফরিদপুরের খেয়ালী নাট্য সম্প্রদায়, রাজশাহীর অনুশীলন নাট্যদল, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার, পাবনা থিয়েটার’৭৭, খুলনার খুলনা থিয়েটার, লোসাউক, আমাদের থিয়েটার, প্রতিনিধি সংস্কৃতি সংস্থা, বাগেরহাটের রুদ্র নাট্যদল, যশোরের উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, রূপকার নাট্য গোষ্ঠী, বিবর্তন যশোর, বিবর্তন ঝিকরগাছা, কুষ্টিয়ার বোধন থিয়েটার, অনন্যা’৭৯ নাট্যদল, কলেজ থিয়েটার, ম্যাজিক ইফ থিয়েটার একাডেমী, ঝিনাইদহের অংকুর নাট্য একাডেমি, বিহঙ্গ সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র, মহেশপুরের বনলতা নাট্য সংসদ, চুয়াডাঙ্গার জেলা শিল্পকলা একাডেমী, অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংলাপ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, চুয়াডাঙ্গা থিয়েটার এবং আলমডাঙ্গার নাগরিক নাট্যদল তাদের নাটকের একাধিক প্রদর্শনী দর্শনায় সম্পন্ন করেছে। এরই মাঝে নাট্য-আন্দোলনে অনন্য অবদানে স্বীকৃতি স্বরূপ অনির্বাণের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মহসিন আলী ঢাকার লোক নাট্যদল প্রবর্তিত ‘নাট্যকর্মী পদক ১৯৯২’ পুরস্কার লাভ করেন। যা আজও এঅঞ্চলের নাট্যমোদীদের কাছে প্রেরণার বিষয়বস্তু হয়ে রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনির্বাণ থিয়েটারের সবচেয়ে বড় অবদান তাদের নিজস্ব নাট্যমঞ্চ নির্মাণ। এক্ষেত্রে একটি নয় দু’টি। অনির্বাণ তাদের প্রথম মঞ্চটি উদ্বোধন করে (বর্তমান দর্শনা ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থলে) ১৯৮৬ সালের ৫ ডিসেম্বর। অনির্বাণ কর্মীরা নাটকের প্রতি গভীর ভালবাসায় ও অক্লান্ত শ্রমে একটি পরিত্যক্ত ইটের ভাটায় প্রসোনিয়ামের আদলে মঞ্চটি নির্মাণ করে। মঞ্চটিকে ঘিরে তাদের মূল পরিকল্পনা ছিল দর্শনায় একটি পূর্ণাঙ্গ কালচারার ইউনিস্টিউট প্রতিষ্ঠার। কিন্তু স্বপ্নে চির ধরে ১৯৯৬-এর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের স্থানীয় এক অংশের একরোখা সিদ্ধান্তে। মঞ্চটি ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য হয় দলের কর্মীরা। কিন্তু রক্তে যাদের নাটকের শ্রোত তাদের কি দমিয়ে রাখা সম্ভব? শুরু হয় আবারও নতুন নাট্যমঞ্চ নির্মাণের প্রচেষ্টা। দলের কর্মীদের ব্যক্তিগত সঞ্চয়, পিতার পকেট কাটা আর মায়ের আঁচল থেকে গোপনে খুলে নেওয়া অর্থের যোগানে নির্মিত হয় (বর্তমান অনির্বাণ কার্যালয় চত্বরে) আরও একটি নতুন নাট্যমঞ্চ। বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনে ক্ষেত্রে অনির্বাণের এই স্বার্থক পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে চুয়াডাঙ্গার গৌররের বিষয়।
এছাড়াও অনির্বাণের উদ্যাগে চুয়াডাঙ্গার অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠন, জীবননগরের ইঙ্গিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ও দর্শনা গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার গড়ে উঠে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় অনির্বাণই প্রথম বাংলাদেশ গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশান ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে দেশব্যপি নাট্য-আন্দোলন প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। নাট্যকলাসহ সহ¯্রমুখি নান্দনিক কর্মকান্ডের ভীরে ‘অনির্বাণ’ আজ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক। বহমান কালের ধারায় আজকের একুশ শতকেও এর বুকে নান্দনিকতার দারুন কোলাহল এবং এর সাথে জড়িত যেসব কলাকুশলী তাদের চোখে বাঙালী সংস্কৃতি আর সৌন্দর্যবোধের আবেশিত চুম্বন, তীক্ষধি ধমনীতে অন্যায়, অবিচার আর অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সদা হয়ে উন্মাদন।