সমীকরণ প্রতিবেদন:
করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় ৬ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা এগিয়ে নিতে মাস চারেক ধরে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরের স্কুলগুলো অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। সারা দেশে প্রায় ৫০ লাখ শিশু শিক্ষার্থী স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারে পাঠগ্রহণ করছে। করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে না আসায় সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও বেশ কিছু দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ অবস্থায় ট্যাব-স্মার্টফোনের মতো খুদে ডিভাইসে ক্লাস করা শিশু শিক্ষার্থীরা মাইয়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টির ঝুঁকিতে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, দেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই কোটি ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৩৮ জন। এর মধ্যে শহরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধেকের কিছু কম। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না থাকলেও শহরাঞ্চলের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ অনলাইনে ক্লাস করছে। এ হিসাবে অনলাইনে ক্লাস করা শিশুর সংখ্যা ৫০ লাখের কম নয় বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা অনুমান করছেন। দেশের প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞরা জানান, অনলাইন ক্লাসে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও স্মার্টফোন চোখের খুব কাছে রেখে ছোট ছোট লেখাগুলো পড়ার কারণে শিশু শিক্ষার্থীদের চোখে মারাত্মক চাপ পড়ছে। কেননা অক্ষিগোলকের আকৃতি যখন স্বাভাবিক থাকে, তখন প্রথমেই আলো গিয়ে চোখের মণিতে (কর্নিয়া) পড়ে। সেখান থেকে মণির ভেতরের আরও কালো যে অংশ, সেই নয়নতারা (পিউপিল) ও লেন্স হয়ে আলো অক্ষিপটে (রেটিনা) পৌঁছায়। অক্ষিপটের কোষগুলো উদ্দীপিত হয়ে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠালে তবেই মানুষ দেখতে পায়। অথচ দীর্ঘ সময় চোখের খুব সামনে রেখে শিশুরা যখন কম্পিউটার, ট্যাব বা মুঠোফোনে অনলাইন ক্লাস করে তখন চোখ বিশ্রাম পায় না। শিশুরা যখন কাছ থেকে এই ডিভাইসগুলো একমনে ব্যবহার করতে থাকে, তখন চোখের মণি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। শিশুরা চোখের পাতা ফেলে না। পাতা ফেললে চোখের ভেতরের পানি চোখের মণিকে আর্দ্র করে। পাতা না ফেললে কর্নিয়ার যে পানি, তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আস্তে আস্তে চোখ শুকিয়ে দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতা সৃষ্টি হয়। চোখের মাংসপেশিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। এতে মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা ও চোখ পিটপিট করার মতো সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, অতিরিক্ত স্ক্রিন অ্যাক্টিভিটি বড়দের চোখের চেয়ে শিশুদের চোখে অনেক বেশি ক্ষতি করে। কারণ তাদের চোখ এখনো পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি। তাই কোমল চোখে স্ক্রিনের আলো পড়লে সেটা সহজেই চোখকে আক্রান্ত করে।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, শৈশবে দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের মূল কারণ তিনটি। এগুলো হলো- জন্মগত সমস্যা, পুষ্টির অভাব ও খুব কাছ থেকে ছোট জিনিস সময় নিয়ে দেখা। প্রথম দুটির কারণে এমনিতেই দেশে বিপুলসংখ্যক শিশু ক্ষীণদৃষ্টিতে ভুগছে। বাবা-মায়ের অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক শিশু দুই-চার বছর বয়স থেকে স্মার্টফোন-ট্যাব ও ল্যাপটপ-কম্পিউটার এবং টেলিভিশনে বিভিন্ন কার্টুন ছবি দেখা কিংবা গেম খেলায় আসক্ত হয়ে চোখের বারোটা বাজাচ্ছে। এর উপর অনলাইন ক্লাস এখন শিশু শিক্ষার্থীদের ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেসরকারি চক্ষু চিকিৎসাকেন্দ্র বাংলাদেশ আই হসপিটাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আগে প্রতিমাসে হাসপাতালটিতে গড়ে চার হাজার শিশু আসতো। যার মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি মাইয়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা ছিল। অথচ গত কয়েক মাস ধরে গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি শিশু চোখের সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে আসছে। যাদের মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশের মাইয়োপিয়া সমস্যা রয়েছে। তাদের বেশিরভাগ অভিভাবক জানিয়েছেন, প্রতিদিন অনলাইনে টানা দেড়-দুইঘণ্টা ক্লাস এবং পরবর্তীতে আরও দীর্ঘ সময় ব্যয় করে মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাব থেকে পড়া তোলার কারণে তাদের সন্তানরা চোখের সমস্যায় পড়ছে। বেশ কিছু বাবা-মা জানিয়েছেন, তাদের শিশু সন্তানদের আগে থেকেই মোবাইল ফোন ও ট্যাবে গেম খেলা এবং কার্টুন ছবি দেখার আসক্তি ছিল। এ কারণে তারা আগে থেকেই চোখ পিটপিট করতো। অনলাইনে ক্লাস শুরু করার পর তারা এখন চোখে ঝাপসা দেখছে। অনেকে খালি চোখে মোবাইল স্ক্রিনের ছোট লেখা পড়তেও পারছে না। এ অবস্থায় তারা বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। কোনো কোনো অভিভাবক জানিয়েছেন, তাদের শিশু সন্তানদের মোবাইল ফোনে গেম খেলা ও ভিডিও দেখার আসক্তি থাকায় তারা এতোদিন এসব ডিভাইস তাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তবে অনলাইনে ক্লাস শুরু হওয়ার পর বাধ্য হয়ে তা তাদের হাতে তুলে দিতে হয়েছে। এ সুযোগে তারা লেখাপড়ার পাশাপাশি গোপনে মোবাইল ফোনে গেম খেলছে ও কার্টুনসহ বিভিন্ন ভিডিও দেখছে। বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারণে সব সময় তাদের নজরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে, অসময়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ায় শিশু শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ঘুমাতে না পারার কারণেও তাদের চোখে বাড়তি চাপ পড়ছে বলে অভিভাবকরা অনেকে অভিযোগ করেছেন। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের মালিবাগ শাখার ইংলিশ ভার্সনের নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একাধিক অভিভাবক জানান, পেশাগত কারণে তাদের অনেক রাতে ঘুমাতে যেতে হয়। সে কারণে তাদের সকালে ঘুম থেকে উঠতে কিছুটা দেরি হয়। এজন্য তারা তাদের শিশু সন্তানদের মর্নিং শিফটে ভর্তি না করে ডে শিফটে ভর্তি করিয়েছেন। অথচ স্কুল শিক্ষকরা এখন সকাল সাড়ে ৮টায় অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। এতে তাদের শিশু সন্তানদের আধাঘুম চোখ নিয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে কোনো লাভ না হওয়ায় কেউ কেউ এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও ভাবছেন।
শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞরা জানান, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটারের চেয়ে স্মার্টফোনে অনলাইন ক্লাস করা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা এর স্ক্রিন বেশ ছোট। যে কারণে চোখের উপর অনেক বেশি চাপ পড়ে। এছাড়া স্মার্টফোনের তীব্র আলো চোখের জন্য ক্ষতিকর। যদিও দামি ফোনগুলোতে তা অটো অ্যাডজাস্ট হওয়ার সুযোগ রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার নেই। তারা বেশিরভাগ কমদামে কেনা নিম্ন মানের স্মার্টফোনে অনলাইন ক্লাস করছে। যা তাদের চোখের সমস্যার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশের শিক্ষাবিদরা বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকায় বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে শিশুর চোখের বিষয়টি বিবেচনায় রাখাও জরুরি। কেননা অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে শিশুর কোমল চোখে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিলে কৈশোর পেরোনোর আগেই তাদের শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটতে পারে। কেননা বিজ্ঞানীদের গবেষণা তথ্যানুযায়ী, ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যাগ্রস্ত শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি পাঁচজনে একজনের দৃষ্টিক্ষমতা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে যায়। তারা আরও বলেন, শিশুদের যে সময় দূরের দৃষ্টি তৈরি হওয়ার কথা, সে সময়ই তারা মোবাইল ফোনের কিংবা ট্যাবের স্ক্রিনে দৃষ্টিকে আটকে রাখছে। যে কারণে দূরের দৃষ্টি প্রসারিত হতে পারছে না। বংশগত কারণেও ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা হতে পারে, তবে স্ক্রিন অ্যাক্টিভিটি, রোদে খেলাধুলা না করা শিশুদের মাইয়োপিয়ার অন্যতম কারণ।
শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতা নিয়ে গবেষণা করা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের কমিউনিটি অফথালমোলজি বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, আগে শহরাঞ্চলের শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণতার হার ছিল ২০ শতাংশ এবং এটা গ্রামের শিশুদের ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ। অথচ অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ার পর তা আরও প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। যদিও গ্রামাঞ্চলে এ হার অনেকটা আগের জায়গাতেই রয়েছে। এতে শুধুমাত্র অনলাইন অ্যাক্টিভিটি বাড়ার কারণেই শহরে ক্ষীণদৃষ্টিতা বেড়েছে তা বলা যাবে না। তবে এর সঙ্গে ক্ষীণদৃষ্টিতার যে বড় সম্পর্ক রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই- যোগ করেন ওই চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই শহরের শিশুদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চশমার পাওয়ারও বাড়ানো লাগছে এবং চশমার প্রয়োজনীয়তা বেশি দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে যেসব শিশু বেশি বই পড়ে, টিভি দেখে, স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটার ইত্যাদির সঙ্গে বেশি সময় কাটায়, তাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হবার আশঙ্কা বেশি। গ্রামের শিশুরা এসব পায় না বলে তাদের মধ্যে এসব থেকে সৃষ্ট সমস্যা অনেক কম। করোনা পরিস্থিতিতে গ্রামে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু না হওয়ায় তারা এ সমস্যা থেকে দূরে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ফ্যাকো সার্জন ও ইউভিআইটিস বিশেষজ্ঞ ডা. মোমিনুল ইসলাম বাধন বলেন, স্কুলগামী শিশুরা এক নাগারে অনলাইনে সময় কাটালে চোখ শুষ্ক হওয়াসহ চোখের মাইয়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা হতে পারে। তাই দীর্ঘক্ষণ অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে অন্তত আধাঘন্টা বিরতি দেওয়া উচিত। ক্লাস পরবর্তীতে শিশুদের মোবাইল, টেলিভিশন ও কম্পিউটারে গেম খেলার ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক হতে হবে। এসব ডিভাইস থেকে নির্গত রঞ্জনরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে শিশুদের ঘুমানোর ৩ ঘণ্টা আগে সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে হবে।