
আমাদের দেশে প্রতি বছর সাধারণত গ্রীষ্মে অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটে। এ সময় আগুনে পুড়ে অনেক মানুষ মারা যায়। আহত হয় বিপুলসংখ্যক। একই সাথে এসব অগ্নিকাণ্ডে শত শত কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়। কিন্তু অগ্নিদুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে যে পরিকল্পনা নেয়া দরকার তা সরকারি তরফ থেকে তেমন একটা দেখা যায় না। কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু দিন চারদিকে আলোচনা হয়- পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে তা থিতিয়ে যায়। এমন বাস্তবতায় গত পাঁচ দিনে রাজধানীসহ কয়েকটি জায়গায় চারটি অগ্নিদুর্ঘটনায় নারী-শিশুসহ কমপক্ষে ৩১ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে দু’টি। পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের অগ্নিকাণ্ড সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। গত মঙ্গলবার বিকেলে সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পাশাপাশি দু’টি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি ভবন সাততলা, আরেকটি পাঁচতলা। এর মধ্যে সাততলা ভবনের বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা বিধ্বস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৮ জন নিহত। সবার স্মরণে থাকার কথা, পুরান ঢাকার নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় শোবার ঘরে আগুনে পুড়ে মা ও দুই শিশুসন্তানের মৃত্যু হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টায় উপজেলার খাকসা উত্তরপাড়া গ্রামে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় তিনতলা একটি ভবনে গত রোববার বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়। গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় চট্টগ্রামে সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে সাতজন নিহত হয়। এসব ঘটনায় আহত হয়েছে বহু মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, সারা দেশে ২০২২ সালে অগ্নিকাণ্ডে ৯৮ জনের মৃত্যু ও আহত হয়েছে ৪০৭ জন। নিহতদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ৮৫ জন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৩ জন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ২০২২ সালের বার্ষিক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে। একই সূত্র মতে, ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। অগ্নিকাণ্ডে ৭২ পুরুষ ও ১৩ সাধারণ নারী মারা গেছে। আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেছে ১৩ জন। আরো জানা যায়, সারা দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এ ছাড়া বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো থেকে ১৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং চুলা থেকে ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দেশে নিয়মিত বিরতিতে কলকারখানায় অগ্নিকাণ্ডে বহু শ্রমিকের প্রাণহানি হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব কলকারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন নিরাপদ কি-না। কারণ, বৈদ্যুতিক ও গ্যাসের লাইন ত্রুটিহীন হলে অহরহ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। এ থেকে এটি সহজে অনুমেয় আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিল্পকারখানা এখনো নিরাপদ কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠেনি। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না, মালিকপক্ষের অধিক মুনাফার লোভ এমন অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এ ছাড়া সরকারের যেসব সংস্থা বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে; এগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ এসব সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বহন করা হয়। অর্থাৎ জনগণের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব পালনে উদাসীনতায় সারা দেশে অগ্নিদুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, যদি কলকারখানা, ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ির বৈদ্যুতিক ও গ্যাসলাইন যথাযথভাবে নজরদারির মধ্যে আনা যায় তা হলে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। একই সাথে যদি সিলিন্ডার গ্যাসের পাত্র নির্দিষ্ট শর্তানুযায়ী তৈরি করা হয়; তবে এর বিস্ফোরণ একেবারে কমিয়ে আনা যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদেরও সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।