ইপেপার । আজমঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

১৬০ বছরের ঐতিহ্য রসকদম্ব-সাবিত্রী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:১৩:৪৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ২৫১ বার পড়া হয়েছে

মিজানুর রহমান, মেহেরপুর:
রস নেই তবু রসকদম্ব ও সাবিত্রী নামের মিষ্টি দুটি মেহেরপুর জেলার ১৬০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে এখনো সগৌরবে তার অবস্থানের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছে ভোক্তাদের কাছে। স্বাদে অতুলনীয়, গুণে ও মানে অদ্বিতীয় এই জনপদের ‘নিরস’ মিষ্টি দুটি ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে প্রাচীন শহর মেহেরপুরের আদি বাসিন্দা বাসুদেব প্রধান নিজে উদ্ভাবন করেন। খড়, টালি ও টিন দিয়ে নির্মিত তাঁর বাড়ির একাংশ ছিল মিষ্টির দোকান। আজ সে স্থানটিতে নির্মিত দোতলা দালানের নিচতলায় ‘বাসুদেব গ্র্যান্ড সন্স’ নাম দিয়ে প্রয়াত বাসুদেবের দুই নাতি বিকাশ কুমার সাহা ও অনন্ত কুমার সাহা ১৬০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি দিয়ে আজও মানুষের রসনা সেবা করে যাচ্ছেন।
অবিভক্ত বাংলার এই অঞ্চলের জমিদার সুরেন বোসের জমিদার বাড়ির সিংহ ফটকের সামনেই ছিল বাসুদেবের সাবিত্রী আর রসকদম্বের দোকানের অবস্থান। জমিদার বাড়িতে মাঝেমধ্যেই আসতেন ব্রিটিশ রাজের অমাত্যবর্গ, রাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, গণ্যমান্য অতিথি ও অন্য অঞ্চলের জমিদাররা। সুরেন বোস বাসুদেবের সেই অতুলনীয় স্বাদের সাবিত্রী আর রসকদম্ব পরিবেশন করে আপ্যায়ন করতেন তাঁদের। আজও দেশের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিদেশি কূটনৈতিক ও বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি মেহেরপুরে এলে তাঁদেরও আপ্যায়নের প্রধানতম মিষ্টান্ন হলো সাবিত্রী আর রসকদম্ব। সাবিত্রী আর রসকদম্ব দীর্ঘদিন বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।
বাসুদেব এন্ড সন্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কুয়েতে বেশি যায় এই দুটি মিষ্টি। প্রবাসীদের মাধ্যমে সেসব দেশের নাগরিকরা এই মিষ্টি সংগ্রহ করেন। বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার এই মিষ্টি বেশি বিক্রি হয়। বিকাশ কুমার সাহা বলেন, ‘এই মিষ্টির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ফ্রিজে না রেখে এক সপ্তাহ আর ফ্রিজে এক মাসেরও বেশি রাখলে একই স্বাদ বজায় থাকে। এই স্বাদ বজায় রাখার জন্য দুই ভাই নিজেদের হাতেই মিষ্টি তৈরি করি। অন্য কাজের জন্য লোক আছে।’ অনন্ত কুমার সাহা বলেন, ‘দুধ তথা দুধের চাছি আর চিনিই মূলত এই মিষ্টি তৈরির উপকরণ। তবে মিষ্টি তৈরির সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে চুলায় জ্বাল দেওয়ার বিষয়টি। নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী নির্ধারিত তাপে মিষ্টির চুলায় জ্বাল দিতে হয়। সুচারুভাবে জ্বাল দেওয়ার কাজটি করতে হয়। সে কারণে আরও বেশি চাহিদার পরও মিষ্টির স্বাদ ও মান ঠিক রাখতে অল্প পরিমাণ মিষ্টি আমরা তৈরি করি। চাহিদা থাকলেও এর বেশি মিষ্টি তৈরি করি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঠাকুর দাদা বাসুদেবের আবিষ্কার এই সাবিত্রী আর রসকদম্ব। তাঁর পরলোকগমনের পর বাবা রবীন্দ্রনাথ সাহা তা আরও বিকশিত করেছেন। তাঁর কাছ থেকেই আমরা মিষ্টি তৈরির কাজটি শিখি। এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা। তাই অন্য কাউকে আমরা এই কাজটা শেখায় না।’
আবদুল মান্নান জানান, তিনি যখন মেহেরপুর স্কুলের ছাত্র, তখন থেকে আজ পর্যন্ত অতুলনীয় স্বাদের এই মিষ্টি উপভোগ করে যাচ্ছেন। জমিদার সুরেন বোসের ছেলে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম নাট্যশিল্পী প্রসেনজি বোস বাবুয়া বলেন, ‘আমাদের জমিদার বাড়ির প্রতিদিনের নানা ধরনের খাদ্য তালিকায় অন্যতম প্রধান ছিল বাসুদেব কাকা এবং তারপর আমার বন্ধু রবির (রবীন্দ্রনাথ সাহা) সাবিত্রী আর রসকদম্ব। আজও আমরা এই মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করি।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

১৬০ বছরের ঐতিহ্য রসকদম্ব-সাবিত্রী

আপলোড টাইম : ১০:১৩:৪৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

মিজানুর রহমান, মেহেরপুর:
রস নেই তবু রসকদম্ব ও সাবিত্রী নামের মিষ্টি দুটি মেহেরপুর জেলার ১৬০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে এখনো সগৌরবে তার অবস্থানের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছে ভোক্তাদের কাছে। স্বাদে অতুলনীয়, গুণে ও মানে অদ্বিতীয় এই জনপদের ‘নিরস’ মিষ্টি দুটি ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে প্রাচীন শহর মেহেরপুরের আদি বাসিন্দা বাসুদেব প্রধান নিজে উদ্ভাবন করেন। খড়, টালি ও টিন দিয়ে নির্মিত তাঁর বাড়ির একাংশ ছিল মিষ্টির দোকান। আজ সে স্থানটিতে নির্মিত দোতলা দালানের নিচতলায় ‘বাসুদেব গ্র্যান্ড সন্স’ নাম দিয়ে প্রয়াত বাসুদেবের দুই নাতি বিকাশ কুমার সাহা ও অনন্ত কুমার সাহা ১৬০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি দিয়ে আজও মানুষের রসনা সেবা করে যাচ্ছেন।
অবিভক্ত বাংলার এই অঞ্চলের জমিদার সুরেন বোসের জমিদার বাড়ির সিংহ ফটকের সামনেই ছিল বাসুদেবের সাবিত্রী আর রসকদম্বের দোকানের অবস্থান। জমিদার বাড়িতে মাঝেমধ্যেই আসতেন ব্রিটিশ রাজের অমাত্যবর্গ, রাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, গণ্যমান্য অতিথি ও অন্য অঞ্চলের জমিদাররা। সুরেন বোস বাসুদেবের সেই অতুলনীয় স্বাদের সাবিত্রী আর রসকদম্ব পরিবেশন করে আপ্যায়ন করতেন তাঁদের। আজও দেশের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিদেশি কূটনৈতিক ও বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি মেহেরপুরে এলে তাঁদেরও আপ্যায়নের প্রধানতম মিষ্টান্ন হলো সাবিত্রী আর রসকদম্ব। সাবিত্রী আর রসকদম্ব দীর্ঘদিন বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।
বাসুদেব এন্ড সন্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কুয়েতে বেশি যায় এই দুটি মিষ্টি। প্রবাসীদের মাধ্যমে সেসব দেশের নাগরিকরা এই মিষ্টি সংগ্রহ করেন। বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার এই মিষ্টি বেশি বিক্রি হয়। বিকাশ কুমার সাহা বলেন, ‘এই মিষ্টির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ফ্রিজে না রেখে এক সপ্তাহ আর ফ্রিজে এক মাসেরও বেশি রাখলে একই স্বাদ বজায় থাকে। এই স্বাদ বজায় রাখার জন্য দুই ভাই নিজেদের হাতেই মিষ্টি তৈরি করি। অন্য কাজের জন্য লোক আছে।’ অনন্ত কুমার সাহা বলেন, ‘দুধ তথা দুধের চাছি আর চিনিই মূলত এই মিষ্টি তৈরির উপকরণ। তবে মিষ্টি তৈরির সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে চুলায় জ্বাল দেওয়ার বিষয়টি। নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী নির্ধারিত তাপে মিষ্টির চুলায় জ্বাল দিতে হয়। সুচারুভাবে জ্বাল দেওয়ার কাজটি করতে হয়। সে কারণে আরও বেশি চাহিদার পরও মিষ্টির স্বাদ ও মান ঠিক রাখতে অল্প পরিমাণ মিষ্টি আমরা তৈরি করি। চাহিদা থাকলেও এর বেশি মিষ্টি তৈরি করি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঠাকুর দাদা বাসুদেবের আবিষ্কার এই সাবিত্রী আর রসকদম্ব। তাঁর পরলোকগমনের পর বাবা রবীন্দ্রনাথ সাহা তা আরও বিকশিত করেছেন। তাঁর কাছ থেকেই আমরা মিষ্টি তৈরির কাজটি শিখি। এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা। তাই অন্য কাউকে আমরা এই কাজটা শেখায় না।’
আবদুল মান্নান জানান, তিনি যখন মেহেরপুর স্কুলের ছাত্র, তখন থেকে আজ পর্যন্ত অতুলনীয় স্বাদের এই মিষ্টি উপভোগ করে যাচ্ছেন। জমিদার সুরেন বোসের ছেলে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম নাট্যশিল্পী প্রসেনজি বোস বাবুয়া বলেন, ‘আমাদের জমিদার বাড়ির প্রতিদিনের নানা ধরনের খাদ্য তালিকায় অন্যতম প্রধান ছিল বাসুদেব কাকা এবং তারপর আমার বন্ধু রবির (রবীন্দ্রনাথ সাহা) সাবিত্রী আর রসকদম্ব। আজও আমরা এই মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করি।’