ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সারাদেশে পুলিশ বেপরোয়া

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:০৬:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮
  • / ৩৫৬ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ ডেস্ক: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ। বিরোধী দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত নেতাকর্মীদের নানাভাবে চরম হয়রানির অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গায়েবি মামলায় আটক, নতুন মামলায় নাম ঢোকানো, জেলগেট থেকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানোসহ পুলিশের বেপরোয়া কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষও। বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও নেতাদের গ্রেফতার করায় কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নামছেন না গ্রেফতার আতঙ্কে। সেনাবাহিনী মাঠে নামার আগেই সারাদেশে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী, নেতাকর্মীদের সার্বক্ষণিক দৌড়ের ওপর রেখেছে বেপরোয়া পুলিশ। প্রার্থী ও নেতাকর্মী, সমর্থকদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যখন-তখন পুলিশ হানা দিয়ে তল্লাশি ও ধরপাকড় করছে। অনেক এলাকায় প্রার্থীদের আত্মীয়-স্বজনরাও পুলিশি হয়রানির শিকার। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ২২৫ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় চারজন হত্যাকান্ডের শিকার হন। একই সময়ে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয় ১৯৫টি। এসব মামলায় ১২ হাজার ৭৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অভিযোগ করেন, তারা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছেন, নৌকা প্রতীকে সিল দেয়ার জন্য তালিকাভুক্ত আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে পুলিশ। সারাদেশের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিএনপির নেতাকর্মীদের তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জমা দিয়েছে। এই তালিকা ধরে নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের না পেয়ে নারী সদস্যসহ পরিবারের লোকজনদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি দেয়া হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও বিএনপি নেতাকর্মীকে না পেয়ে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসিচব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকারি দলের প্রার্থীরা পুলিশ প্রটোকল নিয়ে প্রচার কাজ চালাচ্ছেন। আর বিএনপির প্রার্থীর অনুসারী নেতাকর্মীদের পুলিশ ধরছে, পেটাচ্ছে ও গ্রেফতার করছে। আওয়ামী লীগ নয়, আমাদের প্রতিপক্ষ যেন পুলিশ। নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেন, প্রধান বিরোধী দলগুলোর সদস্য ও সমর্থকদের গ্রেফতার করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে, এমন কি গুম করা হয়েছে। এতে আতঙ্ক ও নিপীড়নের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গত বুধবার নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ভোটের দায়িত্বে থাকা সবাইকে নজরে রেখেছে। গাইবান্ধা জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (এডিসি) প্রত্যাহার করে তাদের স্থানে ‘উপযুক্ত’ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বলেছে ইসি। অন্য দিকে চার পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করার নির্দেশনা পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়। আইজিপির কাছে পাঠানো আলাদা চিঠিতে ডিএমপির রমনা থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম, সোনাইমুড়ী থানার ওসি আবদুল মজিদ, ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার ওসি নবীর হোসেনকে প্রত্যাহারের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ একটি পেশাদার বাহিনী। তারা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করছে। মামলা দায়ের, আসামি গ্রেফতার পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। পুলিশ কোনো ব্যক্তি কিংবা কারো পক্ষে-বিপক্ষে কাজ করছে না। রাজনৈতিক কারণে কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। যাদের নামে থানায় মামলা রয়েছে এবং যারা ফৌজদারি মামলার আসামি তাদেরই কেবল গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ছাড়া অতীতে যারা নাশকতা চালিয়েছে এবং আগামীতে চালানোর সম্ভাবনা রয়েছে তাদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। কোনো সুনিদিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, গত ১৫ ডিসেম্বর শনিবার বিকেলে কয়েক হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক নিয়ে নোয়াখালী-১ (চাটখিল- সোনাইমুড়ীর একাংশ) আসনে বিএনপি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন নির্বাচনী মিছিল করছিলেন। মিছিলের শেষ পর্যায়ে সোনাইমুড়ী থানার ওসি আবদুল মজিদ পুলিশ নিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে মিছিল শেষ করতে বলেন। মিছিল শেষ করছি বলার পর ওসি তা না শুনে মিছিলের ওপর গুলি চালান। তিনি সামনে যেতে থাকলে তাকে লক্ষ্য করে পেছন দিক থেকে গুলি চালান ওসি। গাজীপুর-২ আসনের ধানের শীষ প্রতীকে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী সালাহউদ্দিন সরকার। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে জিএমপির গাছা থানায় ও ১৭ ডিসেম্বর রাতে টঙ্গী পূর্ব থানায় পুলিশ কর্তৃক আয়োজিত প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানে প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব অনুষ্ঠানে জিএমপি কমিশনার, সহকারী কমিশনারসহ মহানগর পুলিশের সব থানার ওসি ও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ তাদের দলীয় প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। থানায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও তাদের দলীয় কর্মীদের নৈশভোজের পর গভীর রাত পর্যন্ত গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে নৌকা প্রতীকের বিজয় নিশ্চিত করতে জিএমপির সব থানার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়। এই নির্দেশনার পর থেকে পুলিশ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ, আজিমপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর, আদাবর, তেজগাঁও, রামপুরা, সবুজবাগ, পল্টন, শাহজাহানপুর, ভাষানটেক, কাফরুল, বনানী, তুরাগ, উত্তরা, রমনা, খিলগাঁও ও ধানমন্ডি এলাকাসহ স্থানীয় বাসীন্দা ও নেতাকর্মীরা বলেন, দিনের বেলা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রচার-প্রচারণায় সাদা পোশাকে পুলিশ এসে সোর্সদের সহায়তায় কর্মী-সমর্থকদের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারসহ বিভিন্ন উপায়ে এসব ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে।

নেতাকর্মীরা বলেন, প্রায় প্রতি রাতেই ৩০ থেকে ৫০ জনের একটি টিম নিয়ে এসে পুলিশ অভিযান চালায়। যার কারণে গ্রেফতারের ভয়ে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের সবাইকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। গত কয়েকদিনে রাজধানী থেকে প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে সংগঠনটি অভিযোগ করেছে। শফিউল আলম, বিশেষ সংবাদদাতা চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেপরোয়া পুলিশি হয়রানি চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধানের শীষের সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের প্রধানত আগেভাগে টার্গেট করেই পুলিশি ধরপাকড় ও আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। যাতে তৃণমূলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা নিজেদের এলাকার ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট হতে না পারে কিংবা ভয়ভীতির কারণে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। আগামীকাল (সোমবার) থেকে সেনাবাহিনী মাঠে নামার আগেই চট্টগ্রামে ধানের শীষের প্রার্থী, নেতাকর্মীদের সার্বক্ষণিক দৌড়ের ওপর রেখেছে বেপরোয়া পুলিশ। বিএনপি জোটের প্রার্থী ও নেতাকর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যখন-তখন পুলিশ হানা দিয়ে তল্লাশি ও ধরপাকড় করছে। অনেক এলাকায় প্রার্থীদের আত্মীয়-স্বজনরাও পুলিশি হয়রানির শিকার। এতে করে নির্বাচনী মাঠে যেখানে উৎসাহ-উৎসব ও স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ বিরাজমান থাকার কথা, সেখানে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। বিএনপি জোট নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন, গায়েবি মামলা, হুলিয়া, বহু পুরনো মামলার ছল-ছুঁতোয় পুলিশ প্রতিদিনই বিএনপি জোটের মাঠের নেতাকর্মীদের আটক করছে। ঘন ঘন বাড়িঘরে খোঁজাখুঁজি, প্রচার-গণসংযোগে মাঠে না আসার জন্য শাসিয়ে দেয়াসহ হরেক উপায়ে ভয়ভীতির সৃষ্টি করছে। অঘোষিত পুলিশি নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত পরিবেশে এবং পুলিশের নজর এড়িয়ে ভোটের প্রচার-প্রচারণা, গণসংযোগ করতে হচ্ছে সরকার-বিরোধী পক্ষের মাঠকর্মীদের। শুধু ধানের শীষ নয়, হাতপাখা এমনকি মহাজোটের লাঙল মার্কার প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে পুলিশ। মহানগরী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-জনপদে হয়রানির মাত্রা ক্রমেই বেড়েছে।
বন্দরনগরীর চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর) আসনের প্রার্থী দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান জানিয়েছেন, কোনো একটি এলাকায় গণসংযোগ করে ফিরে আসতে না আসতেই খবর পাই সেখানে স্থানীয় নেতাকর্মীদের পুলিশ হয়রানি, আটক করছে। গণসংযোগে না নামতে কড়া ভাষায় পুলিশ শাসিয়ে দিচ্ছে। এভাবে আমাদের নির্বাচনী তৎপরতার সাথে পুলিশের হয়রানির মাত্রাও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। একই অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবু সুফিয়ান, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মো. ইসহাক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে প্রার্থী দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ও একই আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থী চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, পার্বত্য খাগড়াছড়ি আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ অনেকেই। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলী জানান, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের ইপিজেড এলাকায় গত শুক্রবার বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর গণসংযোগ থেকে ফেরার পথে ১০ জনকে কর্মীকে আটক করে পুলিশ। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও বন্দর থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। একই কায়দায় নগরীর ষোলশহর ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি মো. মনসুর আলম এবং পূর্ব বাকলিয়া ছাত্রদল নেতা ইসমাইল হোসেনকে পুলিশ আটক করে। বাঁশখালীতে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলে প্রার্থী সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর পথসভায় গত শুক্রবার আ.লীগের হামলা, গুলিবর্ষণের শিকার হয়ে মামলা করতে গেলে থানা থেকে বের করে দেয়া হয়। গতকাল (শনিবার) সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুল ইসলাম আরো অভিযোগ করেন, এমনকি ওই ঘটনায় ৩০ থেকে ৪০ জন নেতাকর্মীকে আটক এবং উল্টো মামলা করেছে পুলিশ।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

সারাদেশে পুলিশ বেপরোয়া

আপলোড টাইম : ১২:০৬:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮

সমীকরণ ডেস্ক: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ। বিরোধী দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত নেতাকর্মীদের নানাভাবে চরম হয়রানির অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গায়েবি মামলায় আটক, নতুন মামলায় নাম ঢোকানো, জেলগেট থেকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানোসহ পুলিশের বেপরোয়া কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষও। বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও নেতাদের গ্রেফতার করায় কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নামছেন না গ্রেফতার আতঙ্কে। সেনাবাহিনী মাঠে নামার আগেই সারাদেশে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী, নেতাকর্মীদের সার্বক্ষণিক দৌড়ের ওপর রেখেছে বেপরোয়া পুলিশ। প্রার্থী ও নেতাকর্মী, সমর্থকদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যখন-তখন পুলিশ হানা দিয়ে তল্লাশি ও ধরপাকড় করছে। অনেক এলাকায় প্রার্থীদের আত্মীয়-স্বজনরাও পুলিশি হয়রানির শিকার। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ২২৫ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় চারজন হত্যাকান্ডের শিকার হন। একই সময়ে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয় ১৯৫টি। এসব মামলায় ১২ হাজার ৭৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অভিযোগ করেন, তারা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছেন, নৌকা প্রতীকে সিল দেয়ার জন্য তালিকাভুক্ত আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে পুলিশ। সারাদেশের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিএনপির নেতাকর্মীদের তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জমা দিয়েছে। এই তালিকা ধরে নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের না পেয়ে নারী সদস্যসহ পরিবারের লোকজনদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি দেয়া হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও বিএনপি নেতাকর্মীকে না পেয়ে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসিচব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকারি দলের প্রার্থীরা পুলিশ প্রটোকল নিয়ে প্রচার কাজ চালাচ্ছেন। আর বিএনপির প্রার্থীর অনুসারী নেতাকর্মীদের পুলিশ ধরছে, পেটাচ্ছে ও গ্রেফতার করছে। আওয়ামী লীগ নয়, আমাদের প্রতিপক্ষ যেন পুলিশ। নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেন, প্রধান বিরোধী দলগুলোর সদস্য ও সমর্থকদের গ্রেফতার করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে, এমন কি গুম করা হয়েছে। এতে আতঙ্ক ও নিপীড়নের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গত বুধবার নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ভোটের দায়িত্বে থাকা সবাইকে নজরে রেখেছে। গাইবান্ধা জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (এডিসি) প্রত্যাহার করে তাদের স্থানে ‘উপযুক্ত’ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বলেছে ইসি। অন্য দিকে চার পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করার নির্দেশনা পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়। আইজিপির কাছে পাঠানো আলাদা চিঠিতে ডিএমপির রমনা থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম, সোনাইমুড়ী থানার ওসি আবদুল মজিদ, ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার ওসি নবীর হোসেনকে প্রত্যাহারের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ একটি পেশাদার বাহিনী। তারা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করছে। মামলা দায়ের, আসামি গ্রেফতার পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। পুলিশ কোনো ব্যক্তি কিংবা কারো পক্ষে-বিপক্ষে কাজ করছে না। রাজনৈতিক কারণে কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। যাদের নামে থানায় মামলা রয়েছে এবং যারা ফৌজদারি মামলার আসামি তাদেরই কেবল গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ছাড়া অতীতে যারা নাশকতা চালিয়েছে এবং আগামীতে চালানোর সম্ভাবনা রয়েছে তাদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। কোনো সুনিদিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, গত ১৫ ডিসেম্বর শনিবার বিকেলে কয়েক হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক নিয়ে নোয়াখালী-১ (চাটখিল- সোনাইমুড়ীর একাংশ) আসনে বিএনপি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন নির্বাচনী মিছিল করছিলেন। মিছিলের শেষ পর্যায়ে সোনাইমুড়ী থানার ওসি আবদুল মজিদ পুলিশ নিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে মিছিল শেষ করতে বলেন। মিছিল শেষ করছি বলার পর ওসি তা না শুনে মিছিলের ওপর গুলি চালান। তিনি সামনে যেতে থাকলে তাকে লক্ষ্য করে পেছন দিক থেকে গুলি চালান ওসি। গাজীপুর-২ আসনের ধানের শীষ প্রতীকে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী সালাহউদ্দিন সরকার। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে জিএমপির গাছা থানায় ও ১৭ ডিসেম্বর রাতে টঙ্গী পূর্ব থানায় পুলিশ কর্তৃক আয়োজিত প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানে প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব অনুষ্ঠানে জিএমপি কমিশনার, সহকারী কমিশনারসহ মহানগর পুলিশের সব থানার ওসি ও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ তাদের দলীয় প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। থানায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও তাদের দলীয় কর্মীদের নৈশভোজের পর গভীর রাত পর্যন্ত গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে নৌকা প্রতীকের বিজয় নিশ্চিত করতে জিএমপির সব থানার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়। এই নির্দেশনার পর থেকে পুলিশ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ, আজিমপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর, আদাবর, তেজগাঁও, রামপুরা, সবুজবাগ, পল্টন, শাহজাহানপুর, ভাষানটেক, কাফরুল, বনানী, তুরাগ, উত্তরা, রমনা, খিলগাঁও ও ধানমন্ডি এলাকাসহ স্থানীয় বাসীন্দা ও নেতাকর্মীরা বলেন, দিনের বেলা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রচার-প্রচারণায় সাদা পোশাকে পুলিশ এসে সোর্সদের সহায়তায় কর্মী-সমর্থকদের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারসহ বিভিন্ন উপায়ে এসব ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে।

নেতাকর্মীরা বলেন, প্রায় প্রতি রাতেই ৩০ থেকে ৫০ জনের একটি টিম নিয়ে এসে পুলিশ অভিযান চালায়। যার কারণে গ্রেফতারের ভয়ে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের সবাইকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। গত কয়েকদিনে রাজধানী থেকে প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে সংগঠনটি অভিযোগ করেছে। শফিউল আলম, বিশেষ সংবাদদাতা চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেপরোয়া পুলিশি হয়রানি চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধানের শীষের সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের প্রধানত আগেভাগে টার্গেট করেই পুলিশি ধরপাকড় ও আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। যাতে তৃণমূলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা নিজেদের এলাকার ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট হতে না পারে কিংবা ভয়ভীতির কারণে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। আগামীকাল (সোমবার) থেকে সেনাবাহিনী মাঠে নামার আগেই চট্টগ্রামে ধানের শীষের প্রার্থী, নেতাকর্মীদের সার্বক্ষণিক দৌড়ের ওপর রেখেছে বেপরোয়া পুলিশ। বিএনপি জোটের প্রার্থী ও নেতাকর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যখন-তখন পুলিশ হানা দিয়ে তল্লাশি ও ধরপাকড় করছে। অনেক এলাকায় প্রার্থীদের আত্মীয়-স্বজনরাও পুলিশি হয়রানির শিকার। এতে করে নির্বাচনী মাঠে যেখানে উৎসাহ-উৎসব ও স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ বিরাজমান থাকার কথা, সেখানে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। বিএনপি জোট নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন, গায়েবি মামলা, হুলিয়া, বহু পুরনো মামলার ছল-ছুঁতোয় পুলিশ প্রতিদিনই বিএনপি জোটের মাঠের নেতাকর্মীদের আটক করছে। ঘন ঘন বাড়িঘরে খোঁজাখুঁজি, প্রচার-গণসংযোগে মাঠে না আসার জন্য শাসিয়ে দেয়াসহ হরেক উপায়ে ভয়ভীতির সৃষ্টি করছে। অঘোষিত পুলিশি নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত পরিবেশে এবং পুলিশের নজর এড়িয়ে ভোটের প্রচার-প্রচারণা, গণসংযোগ করতে হচ্ছে সরকার-বিরোধী পক্ষের মাঠকর্মীদের। শুধু ধানের শীষ নয়, হাতপাখা এমনকি মহাজোটের লাঙল মার্কার প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে পুলিশ। মহানগরী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-জনপদে হয়রানির মাত্রা ক্রমেই বেড়েছে।
বন্দরনগরীর চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর) আসনের প্রার্থী দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান জানিয়েছেন, কোনো একটি এলাকায় গণসংযোগ করে ফিরে আসতে না আসতেই খবর পাই সেখানে স্থানীয় নেতাকর্মীদের পুলিশ হয়রানি, আটক করছে। গণসংযোগে না নামতে কড়া ভাষায় পুলিশ শাসিয়ে দিচ্ছে। এভাবে আমাদের নির্বাচনী তৎপরতার সাথে পুলিশের হয়রানির মাত্রাও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। একই অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবু সুফিয়ান, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মো. ইসহাক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে প্রার্থী দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ও একই আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থী চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, পার্বত্য খাগড়াছড়ি আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ অনেকেই। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলী জানান, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের ইপিজেড এলাকায় গত শুক্রবার বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর গণসংযোগ থেকে ফেরার পথে ১০ জনকে কর্মীকে আটক করে পুলিশ। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও বন্দর থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। একই কায়দায় নগরীর ষোলশহর ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি মো. মনসুর আলম এবং পূর্ব বাকলিয়া ছাত্রদল নেতা ইসমাইল হোসেনকে পুলিশ আটক করে। বাঁশখালীতে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলে প্রার্থী সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর পথসভায় গত শুক্রবার আ.লীগের হামলা, গুলিবর্ষণের শিকার হয়ে মামলা করতে গেলে থানা থেকে বের করে দেয়া হয়। গতকাল (শনিবার) সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুল ইসলাম আরো অভিযোগ করেন, এমনকি ওই ঘটনায় ৩০ থেকে ৪০ জন নেতাকর্মীকে আটক এবং উল্টো মামলা করেছে পুলিশ।